PG POLITICAL SCIENCE FINAL EXAM NOTES
PG – PS – 1 NOTES
PG PS NOTES
PG POLITICAL SCIENCE FINAL NOTES
1) জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি ব্যাখ্যা করো ?
2) জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান বিশ্লেষণ করুন?
3) উপনিবেশিক ভারতে দলিত আন্দোলনের উপর একটি নিবন্ধ লিখুন ?
4) কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য লিখো ?
5) ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে সৈয়দ আহমেদ খানের দৃষ্টিভঙ্গি একটি মূল্যায়ন করুন?
6) সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদী চিন্তার বৈশিষ্ট্য গুলি বিশ্লেষণ করুন?
7) ‘নয়া মানবতা‘ প্রসঙ্গে এম. এন. রায়ের ধারণা আলোচনা করুন?
8) জয় প্রকাশ নারায়ণ মার্কসবাদী প্রহাবকে কিভাবে অতিক্রম করেছিলেন তা আলোচনা করুন ?
9) ‘ সর্বোদয় ‘ধারণাটি কার সঙ্গে জড়িত এবং এর অর্থ কি?
10) ‘ আনন্দমঠ ‘ –কে জাতীয়তাবাদী উপন্যাস বলা হয় কেন ?
11) ‘ সামগ্রিক বিপ্লব ‘ বলতে জয়প্রকাশ নারায়ণ কি বলতে চেয়েছিলেন ?
12) ভারতের দলিত আন্দোলনে জ্যোতিবা ফুলের ভূমিকা সংক্ষেপে আলোচনা করুন?
13) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতে সংঘটিত বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করো।
1) জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি ব্যাখ্যা করো ?
Answer – ভূমিকা:-বঙ্কিমচন্দ্র ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় তাঁর রচনার দিক থেকে একজন অটল ছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয়তাবাদের অন্যতম পথিকৃৎ এবং একজন হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী। উপন্যাস, প্রবন্ধ ও প্রবন্ধের আকারে তাঁর গদ্য লেখা প্রকাশের আগে জাতীয়তাবাদ কোনও ভারতীয় ঘটনা ছিল না। ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে এটি পশ্চিম থেকে আমদানি করা হয়েছিল। এই ধরনের ইংরেজি শিক্ষা ভারতীয়দের উপযোগিতাবাদ এবং ফরাসি বিপ্লবের মতাদর্শের উন্মোচন করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের রাজনৈতিক চিন্তা উপযোগিতাবাদের বৈশিষ্ট্য এবং ফরাসি বিপ্লবের মতাদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি মনে করতেন, ইউরোপের মতো ভারতের উত্থান কেবল জাতীয়তাবাদের সাহায্যেই সম্ভব হবে। তিনি ভাল করেই অবগত ছিলেন যে ইংরেজি শিক্ষার যৌক্তিক উপাদান, যা জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার ভিত্তি, শুধুমাত্র হিন্দু সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে না। জাতীয়তাবাদের ইউরোপীয় ধারণা এবং জাতীয়তাবাদের ভারতীয় ধারণার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের ধারণা সকলের কল্যাণের জন্য ভালবাসার আদর্শের উপর ভিত্তি করে। তার জাতীয়তাবাদের ধারণা তার বিপ্লবী উপন্যাস আনন্দমঠে রূপ নেয় । সেই উপন্যাসে ব্যবহৃত উপন্যাস এবং গান বন্দেমাতরম উভয়ই ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় জাতীয়তাবাদের ধারণাটি বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।
উনিশ শতকের ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে তৎকালীন দেশাত্মবোধক ও স্বদেশ প্রেম মূলক সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। পাশাপাশি গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী ছবিগুলিও ভারতীয় জাতীয়তা বোধের বিকাশে উল্লেখযোগ্যয ভূমিকা করে। প্রকৃতপক্ষে উনিশ শতকের লেখায় ও রেখায় ভারতীয়় জাতীয়তাবোধের এক বিশাল বিকাশ সংঘটিত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দমঠ“, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “গোঁড়া“, স্বামী বিবেকানন্দের “বর্তমান ভারত” এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতা চিত্র গুরুত্ব্
অপরিসীম।
“আনন্দমঠ“এর অবদান:- বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ প্রগাঢ় ও প্রভাব ফেলেছিল জাতীয়তাবাদীদের ওপর । আনন্দমঠ এর সন্তানদের উচ্চারিত বন্দেমাতরাম মন্ত্র দেশবাসীকো মুক্তি আন্দোলনে আন্দোলিত করে। এই গ্রন্থে দেশমাতৃকার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত মূর্তিগুলি তুলে ধরেন বঙ্কিমচন্দ্র। “মা যাাহা হইয়াছেন“- দশ জননীর এই মূর্তি হৃতসর্বস্ব নগ্নিকা দেশ এর মূর্তি। এই মূর্তির মাধ্যমে শোষণ মুক্তা, কল্যাণী, জগদ্ধাত্রী দেশমাতৃকার মূর্তিকে তুলে ধরেছেন । আনন্দমঠ এর সন্তানদের আদর্শ ভারতের শিক্ষিত যুব সমাজকে বিশেষ করে কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের একাংশকে অনুপ্রাণিত করে। সন্তানদের উদ্দেশ্যে সত্যানন্দ এর আহবাণ এর মধ্যে তিনি আসুরিক ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ধর্মান্ধতা জাগানোর ডাক শুনেছেন। অসুরবিনাশিনী দেবী দুর্গার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে উঠে ছিল অরবিন্দের স্বপ্নের দেশ মাতৃকার মূর্তি। আনন্দমঠ উপন্যাসটি সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রচারে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। এই গ্রন্থে তিনি একদল দেশপ্রেমিকের আত্ম উৎসর্গের কথা তুলে ধরেছেন। স্বাদেশিকতা প্রসারে বন্দেমাতরম সংগীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সংগীতের দ্বারা বঙ্কিমচন্দ্র ভারত জননীর বাস্তব রূপ অংকন করেন এবং পরবর্তীকালে এই সংগীত ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামের উপর রূপ ধ্বনিতে পরিণত হয়। প্রত্যেকটি স্বদেশ প্রেমিকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় এই বন্দেমাতরম ধ্বনি।
বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনার শুরুতেই আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত জাতি বিষয়ক ধারণা। তিনি যে জাতির বিষয়ে কথা বলেছেন সেটির কৌমগত, ভৌগোলিক ও সামাজিক উপাদানের ব্যাপারে ধোঁয়াশা আছে। কখনও কখনও তিনি ‘ভারতীয়’ শব্দটি যে অর্থে আমরা শব্দটি বর্তমানে ব্যবহার করি, সেই অর্থে ব্যবহার করেননি। তাঁর বিচারে ‘ভারতীয়’র পরিধিতে কেবল ‘বাঙালি’ ও ‘হিন্দু’ও কখনও কখনও ঢুকে পড়েছে।
এই পরিধির ব্যাপ্তির বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সুদীপ্ত কবিরাজ তাঁর ‘দ্য আনহ্যাপি কনশাসনেস’ গ্রন্থে (প্রকাশক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস) লিখেছেন, যে এটাই হল কল্পনাপ্রসূত ইতিহাস (imaginary history) লেখার সুবিধা। ধ্যানধারণাগত অনির্ণেয়তা (Conceptual indeterminacy)-র বালাই সেখানে নেই। সুদীপ্ত কবিরাজ লিখেছেন, “Such writers use fuzziness of the community to give their audience a community which had not existed before, by gradually conceiving a community called the nation.” [এ ধরনের লেখকরা কৌম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ধোঁয়াশা বজায় রাখেন যাতে সম্প্রদায়টির অস্তিত্ব সুসংজ্ঞাতভাবে অতীতে না–থাকলেও আস্তে আস্তে জাতির সংজ্ঞাটি অধিগত করে ফেলে।
ধর্মতত্ত্ব (অনুশীলন): বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব (অনুশীলন) গ্রন্থের আদর্শে ও এর নাম অনুসারে বঙ্গের সবথেকে খ্যাতনামা বিপ্লবী সমিতি ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০২–এ। অনুশীলন সমিতির বিশিষ্ট বিপ্লবী জীবনতারা হালদার তাঁর অনুশীলন সমিতির ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন যে ‘‘ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন তত্ত্বে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সমন্বিত আদর্শ মানব গঠনের যে নির্দেশ আছে তাহাই হইল অনুশীলন সমিতির ভিত্তি।’’
বঙ্কিমের ইতিহাস চেতনাঃ বঙ্কিমচন্দ্র ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ প্রবন্ধে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘সাহেবরা যদি পাখি মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই।’’ বঙ্কিম বুঝেছিলেন সঠিক ইতিহাস–জ্ঞান একটি জাতির উত্থানের জন্য আবিশ্যিক। আর মিথ্যা, বিকৃত ইতিহাস যে একটি জাতিকে ভিতর থেকে ফাঁপা করে দিতে পারে তাও তিনি বুঝেছিলেন। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘‘ঐতিহাসিক গবেষণায় বঙ্কিমচন্দ্র’’ প্রবন্ধে ইউরোপে যখন বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস–চর্চার শৈশবাবস্থা এবং বঙ্গে যখন ইতিহাসচর্চা প্রায় শুরুই হয়নি বলা যায়, সেই সময় বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাস–চেতনা ও ইতিহাস–লেখনীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বঙ্কিম মিনহাজ উস সিরাজের তবকৎ–ই–নাসিরী–তে প্রাপ্ত বখতিয়ার খলজীর সপ্তদশ অশ্বারোহী নিয়ে বঙ্গ–বিজয়ের কাহিনিতে কোনদিনই বিশ্বাস করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সপ্তদশ অশ্বারোহী লইয়া বখতিয়ার খিলিজি বাঙ্গালা জয় করিয়াছিল, একথা যে বাঙ্গালীতে বিশ্বাস করে, সে কুলাঙ্গার।’’ তিনি এই ঘটনাকে অসম্ভব বলে মনে করেন এবং বখতিয়ার যে বঙ্গের খুব কম অংশকেই দখল করতে পেরেছিলেন, তাও উল্লেখ করেন। বর্তমানে আমরা জানি যে বঙ্কিমের দাবী ঐতিহাসিকভাবে সত্য। বখতিয়ার শুধু কয়েক বছরের জন্য বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবঙ্গের কিছু অংশ দখলে রাখতে পেরেছিলেন। বাকি উভয় বঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চলই লক্ষ্মণ সেনের পুত্র বিশ্বরূপ সেন, কেশব সেন–সহ তাঁর উত্তরাধিকারীরা বহু বছর যাবৎ শাসন করেন। মৃণালিনী উপন্যাসেও বঙ্কিম বখতিয়ার–সংক্রান্ত কিংবদন্তিটির বিরোধিতা করেছেন।
বঙ্গদেশের কৃষকঃ বঙ্কিমচন্দ্র নিজ দেশীয় ঐতিহ্য, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতির ওপর জোর দিলেও কিছু বামপন্থী বা অতিবামপন্থী যেভাবে তাঁকে ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী বা এলিটিস্ট হিসাবে দাগানোর অপচেষ্টা করেন তা কখনই ঠিক নয়। কারণ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ও বর্ণের কথা আমরা তাঁর লেখায় পাই। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘বঙ্গদেশের কৃষক’। এই প্রবন্ধে তিনি বঙ্গের কৃষকদের দুরবস্থার কথা লিখেছেন। তৎকালীন সমাজের অধিকাংশ বিশিষ্ট ব্যক্তিই যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ– তখন তিনি এই ব্যবস্থার ফলে কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে কলম ধরেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, বঙ্গদেশের কৃষকদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান এবং বাকীরা তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু। কিন্তু এদের জন্যই বঙ্কিম কলম ধরেছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রকাশঃ
উনবিংশ শতকের সাহিত্য জগতের নক্ষত্র ও বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক স্রষ্টা যে তাঁর সাহিত্য রচনার মাধ্যমেই ভারতবর্ষের জাতীয় জাগরণ ও মুক্তি সংগ্রামকে আলোড়িত করবেন সেটাই কাম্য।বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমযুগের সুচনার সাথে সাথেই ধর্ম, সামাজিক আদর্শ, ও দেশ প্রিতী নতুন রূপে ধরা দিল। বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘ভারত–কলঙ্ক’ ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রবন্ধে তাঁর প্রগাঢ় দেশ প্রীতির নিদর্শন মেলে।মৃণালিনীতে সূচনা হয় স্বাজাত্যবোধের। বিশিষ্ট সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বলেছেন মৃণালিনীতেই বঙ্কিমচন্দ্র প্রত্যক্ষ পূজক রূপে গৈরিক উত্তরিয় পরিধান করে মন্দিরে প্রবেশ করেন। দেশের জন্য উপন্যাসের নায়ক হেমচন্দ্রের স্বার্থত্যাগ– তাঁর আত্মোৎসর্গের প্রবল আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই নবযুগের মহিমান্বিত ঋষির ধ্যানযোগের রুপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশ মাতৃকার পূজায়োজনের সূত্রপাত এখানেই। সে আয়োজনের পুজা সার্থক হয়ে উঠেছে ‘ আনন্দমঠে’।মৃণালিনীতে সাধকের কাছে মাতৃপূজার যোগের পন্থা ,নিয়ম, মন্ত্র যেন অস্পষ্ট– সেজন্য সেখানে প্রবল হয়ে উঠেছে দেশানুরাগের প্রবল উচ্ছ্বাস। অন্যদিকে আনন্দমঠে ঋষি যেন সিদ্ধপুরুষ। আনন্দমঠে দেশপুজা–পদ্ধতী পাশ্চাত্য পদ্ধতীর অনুকরণ নয়– ভারতীয় সংস্কৃতির চিরাচরিত নিষ্কাম স্বদেশ প্রেম।
বঙ্কিম ইংরেজদের চিন্তা ভান্ডার থেকে সংরহ করে আনেন স্বাতন্ত্র্য প্রিয়তা ও জাতি প্রতিষ্ঠার আইডিয়া।আর সেই আইডিয়াকে সাহিত্যে বাণী মূর্তি দিলেন আনন্দমঠে,দেবীচৌধুরানীতে, কৃষ্ণতত্বে।Ideas rules the world- একথা যদি সত্য হয় তবে এটা স্বীকার্য দেবীচৌধুরানী, আনন্দমঠ, কৃষ্ণচরিত্র ও ধর্মতত্ব বর্তমান ভারতবর্ষকে সৃষ্টি করেছে তাঁর কানে ন্যাশনালিজমের মহামন্ত্র শুনিয়ে।তাই বলা যেতেই পারে বিষবৃক্ষ আর কপালকুণ্ডলার বঙ্কিম আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনা করলেও নব্য ভারতের স্রষ্টার যে গৌরব– সেই গৌরবের দাবী করবে আনন্দমঠ ও কৃষ্ণতত্বের বঙ্কিম। দেশপ্রীতি তাঁর কাছে দেখা শুধু শুকনো কর্তব্য হিসেবে ধরা দেয়নি, স্বদেশ প্রেম তাঁর কাছে ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম। ‘ধর্ম্মতত্বে’- লেখা আছে” আরো বুঝিয়াছি,আত্মরক্ষা হইতে স্বজনরক্ষা গুরুতর ধর্ম , স্বজন রক্ষা হইতে দেশ রক্ষা গুরুতর ধর্ম। যখন ঈশ্বরে ভক্তি এবং সর্ব্বালোকে প্রীতি এক তখন বলা যাইতে পারে যে, ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন দেশপ্রীতি সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম।” ঋষিঅরবিন্দের মতে,-“ The religion of patriotism-This is the master idea of Bunkim’s writing.
ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন দেশপ্রীতিই যে জীবনের পরম ধর্ম– সাহিত্যকে আশ্রয় করে এই বাণী প্রচারে বঙ্কিম আত্মনিয়োগ করেছিলেন কেন? কারণ বঙ্কিম সমস্ত চিত্ত দিয়ে ভালোবেসেছিলেন তাঁর স্বদেশের লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত, অর্ধনগ্ন, মেরুদন্ডহীন নরনারীকে। বাস্তবের হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেচিত্ত তাঁর অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিল–
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে বলা হচ্ছে– “ জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী ”-অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। নবীন বাংলার মন্ত্রগুরু বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আমার দুর্গোৎসব’- প্রবন্ধে দেশকে বললেন মা দুর্গা, আহ্বান জানালেন গৃহে ফিরে আসার। তিনি বললেন যে দেশই মা, দেশই স্বরগ,দেশই ধর্ম, দেশইদেবতা ,দেশই হল জ্ঞান, ভক্তি, ধর্ম, প্রাণ, হৃদয় ও শক্তি।দেশ শুধু মা নন তিনি দুর্গতি নাশিনী দুর্গা। তিনি লিখলেন, “ যে মনুষ্য ‘জননীকে স্বর্গাদপী গরীয়সী’ মনে না করতে পারে, সে মনুষ্য, মনুষ্য–মধ্যে হতভাগ্য। যে জাতি জন্মভূমিকে ‘স্বর্গাদপী গরিয়সী’ মকনে না করিতে পারে , সে জাতি , জাতি–মধ্যে হতভাগ্য। ”
বঙ্কিমচন্দ্রের জাতিয়তাবাদি চেতনার সোনালী ফসল হল ‘আনন্দমঠ’। আনন্দমঠের মাধ্যমে বঙ্কিম যে কেবল দেশপ্রেম জাগ্রত করেছিলেন তাই নয়– এই মহা গ্রন্থের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন এক নতুন দরশন ও আদর্শবাদ। আনন্দমঠ–এর সন্তান্দলের এক্মাত্র দেবতা হলেন–জননী জন্মভুমি। হিন্দুর তেত্রিশ কোটি দেবতাকে স্থানচ্যুত করে তাঁদের শূন্য আসনে বসানো হয়েছে জননী জন্মভূমিকে। নতুন এই ধর্ম , হিন্দু ধর্ম বা মুসলিম ধর্ম নয়– তা দেশধর্ম । ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন যে, “ Bankim chandra converted ptariotism into religion and religion into ptriotism.”
2) জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান বিশ্লেষণ করুন?
Answer – জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণাঃ—জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরনের জাতীয়তাবাদী ভাবনা একদিকে যেমন স্বদেশি চেতনার সীমিত গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, অন্যদিকে তেমনই ইউরোপীয় জাতীয়তাবোধের অহমিকার মধ্যেও সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বমানবতাবাদের পূজারি। তাই তার জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা ছিল। আন্তর্জাতিক চিন্তাভাবনার আলোয় আলোকিত। জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে চেয়েছিলেন, সেখানে কোনোরকম সংকীর্ণতার স্থান ছিল না।
ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের সমালোচনা: রবীন্দ্রনাথ তাঁর‘ন্যাশনালিজম‘ (Nationalism) গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নিজের মৌলিক চিন্তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। 1916-17 খ্রিস্টাব্দে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সময় বিভিন্ন জায়গায় তিনি যেসব বক্তৃতা নেন, সেগুলি নিয়েই তাঁর ‘ন্যাশনালিজম‘ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ, বিশেষত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের তাঁর সমালোচনা করেন। পাশ্চাত্যের মাটিতে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম, তাকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ শুধু ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিরোধ আর বিচ্ছেদের জন্ম দেয়। এই জাতীয়তাবাদ ধর্ম, মানবতাবাদ, নীতিবোধ ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এই কারণে পশ্চিমের দেশগুলিতে মারামারি–হানাহানি নিরন্তর ঘটে চলেছে। ‘ন্যাশনালিজম‘ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ‘জাতীয়তাবাদ‘ সম্পর্কে তাঁর কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। নিজের দেশ, নিজের জাতি বড়ো আর অন্য সব দেশ, অন্য সব জাতি ছোটো ও নীচজাতীয়তাবাদের এই ধারণা যে বিভেদের বীজ বপন করে, তা ক্রমশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত তা দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে গ্রাস করে সময় বিশ্বে আধিপত্য কায়েমে সচেষ্ট হয়। এজন্য রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমি জাতীয়তাবাদকে আধিপত্যবাদ বা প্রভুত্ববাদ বলে অভিহিত করেছেন।
পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, ইউরোপ তথ্য পশ্চিমের যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি হল জাতীয়তাবাদ। পরাধীন দেশগুলিকে শোষণ করে রিক্ত করে তোলাই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। পাশ্চাত্য সভ্যতার জাতীয়তাবাদ সমগ্র মানবজাতি এবং সমগ্র মানবসভ্যতার পক্ষে এক ভয়াবহ বিপদ। জীবনের অন্তিম লগ্নে ‘সভ্যতার সংকট‘ প্রবন্ধে গভীর দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা–অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে। মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি … জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।“
জাতি ও জাতীয়তাবাদ : রবীন্দ্রনাথ তাঁর “শিক্ষার মিলন‘ প্রবন্ধে একথা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জাতি (nation) গঠিত হয়েছে সত্যের জোরে কিন্তু জাতীয়তাবাদ (Nationalism) সত্য নয়। তাঁর মতে, জাতীয়তাবাদ এমন এক ধরনের দুর্বুদ্ধি, যেখানে দেশের আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পায়। এ এমন এক রিপু যেখানে সকলের দিকে নয়, নিজের দিকেই টান বেশি থাকে।
জাতির চেয়ে মানুষ বড়ো: মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতির চেয়ে মানুষই ছিল বড়ো। তাই তিনি জাতিপূজার কঠোর বিরোধিতা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, জাতীয়তাবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তাতে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে। জাতীয়তাবাদী ধারণা ব্যক্তিমানুষকে বলি দেয়। এখানে মানুষের সৃজনশীল সত্তার স্বাধীন বিকাশ ঘটে না। ব্যক্তিমানুষ নেশনের অধীনে যজ্ঞে পরিণত হয়। জাতীয়তাবাদের জাতীয় গরিমার যে আবেগ মানুষের মনে বিভেদের সৃষ্টি করে, তা ক্রমশ মানুষকে দানবে পরিণত করে। মানুষের যাবতীয় শুভ চিন্তা, শুভ চেতনা সব ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার সংকট ডেকে আনে।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ : রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ—পশ্চিমি সভ্যতার এই পথ কখনোই ভারতবর্ষের পথ হতে পারে না। ভারত কখনোই পাশ্চাত্যের ধারণায় ‘নেশন‘ বা ‘জাতি‘ ছিল না। ভারতের ‘জাতি‘ সম্পর্কিত সমস্যা থাকলেও তা রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল না, ভারতের সামাজিক ব্যবস্থা তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। তাই নানা যোদ্ধা জাতি ভারতে এসেছে কিন্তু তারা কেউ ভারতের সমাজব্যবস্থাকে স্পর্শ করতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছিলেন। যে ‘নেশন‘ বা ‘ন্যাশনালিজম‘-এর উগ্র উন্মাদনার দানবীয় রূপ কখনও ভারতের কাম্য হতে পারবে না। ভারতের কাম্য হল মহোত্তম মানবিক ও আধ্যাত্মিক ঐক্যে উদ্বুদ্ধ এক বিশ্বজনীন আদর্শের দেশ।
মন্তব্য: সমকালীন পৃথিবী যে সময় উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদের উদগ্র কামনায় মেতে উঠেছিল, সেসময় রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মানবজাতির ঐক্যচেতনার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, মানবজাতির আত্মিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাতীয়তাবাদ–সম্পর্কিত ধারণায় নিজের জাতির মধ্যে সকল জাতির এবং সকল জাতির মধ্যে নিজের জাতির সত্য রূপটিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
3) উপনিবেশিক ভারতে দলিত আন্দোলনের উপর একটি নিবন্ধ লিখুন ?
Answer – ভারতের দলিত আন্দোলন ‘দলিত‘ শব্দটি বিশেষা, যার আভিধানিক অর্থ মর্দিত, মাড়ানো হয়েছে এমন অর্থাৎ পদদলিত, পিষ্ট, দমিত এবং নিপীড়িত প্রভৃতি। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে মুসলমানরা ছাড়াও যেসব সামাজিক গোষ্ঠী কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে নিজেদের অনেকটাই সরিয়ে রেখেছিল, তারা হল অব্রাহ্মণ ও অস্পৃশ্য। বিংশ শতকের তিরিশের দশক থেকে অস্পৃশারা নিজেদের দলিত অর্থাৎ নিপীড়িত বলে পরিচয় দিতে শুরু করে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে এদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাকে বোঝাবার জন্যে দলিত শব্দটি বেশ সুপ্রযুক্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং উপযুক্ত ছিল, ঔপনিবেশিক শব্দ পিছড়েবর্গ বা পশ্চাদপদ শ্রেণীর চেয়ে নিশ্চিতভাবেই ভালো। অন্যদিকে গান্ধিজির দেওয়া হরিজন অর্থাৎ ঈশ্বরের মানুষ‘ আখ্যাটাও ছিল আপত্তিকর, কারণ এই শব্দের মধ্যে কৃপা ও করুণার পাশাপাশি আছে বর্ণাশ্রম দর্শনের প্রতি রক্ষণশীল মনোভাব। বাসব সরকারের মতে সমাজের নিম্নবর্গের শ্রেণীচেতনায় উদাসীন কিন্তু স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে সজাগ সংগঠিত জঙ্গি অংশের নাম দলিত।
১৯৮১ সালের জনগণনায় ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যা ৭৫ কোটির মধ্যে প্রায় ৩৫ কোটি যে মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী বলে চিহ্নিত হয়েছিল, দলিতরা হল তারই একান্তভাবে গোষ্ঠী সচেতন, সংঘবদ্ধ একটি অংশ। দীনেশ ডাকুয়া মনে করেন, দলিত শব্দটি এসেছে “ দলন ” থেকে। “ দলন ” বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো কাউকে গায়ের জোরে বশ মানিয়ে, ওপরে উঠতে না দেওয়া। যেহেতু অতীতে মানুষের দ্বারা মানুষের ওপর আক্রমণ হয়েছে মূলত গোষ্ঠীগতভাবে, সেহেতু দলনকারী এবং পলিত মানুষগুলি অনেক সময়েই ভাগ হয়ে গেছে গোষ্ঠীগতভাবে। ডক্টর অনিলরঞ্জন বিশ্বাস দেখিয়েছেন, ” দলিত ‘ শব্দটি ইংরেজি : depressed’- এর পারিভাষিক প্রতিশব্দ। এর ব্যবহার সম্পর্কে ১৯৩১ সালের আদমশুমারির বঙ্গ এবং অসমের অধ্যক্ষ এ. ঈ. পোর্টার তাঁর পরিশিষ্ট অংশে বলেছেন যে ইউরোপে ঐ শব্দে বোঝায় চিরকালিক দরিদ্র জনগণকে, এছাড়া এই শব্দটি খারাপ আর্থিক অবস্থার দ্যোতক।
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যেআন্দোলন দলিত প্রসঙ্গ নিয়ে যে আলোচনার ব্যবস্থা করেছিল সেখানে সকল বক্তাই “ দলিত ‘ শব্দটির ব্যুৎপত্তি এবং অর্থনির্ণয় প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য রাখেন এবং নিপীড়িত অবহেলিত শূদ্র ও অন্ত্যবর্ণের মানবগোষ্ঠীকেই উক্ত শব্দের প্রতিপাদ্য অর্থ রূপে প্রতিপাদন করেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের সব বর্ণের স্ত্রীলোকই নানাভাবে অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দলিত মানবগোষ্ঠীর পর্যায়ভুক্ত বলে অধিকাংশ বক্তাই মন্তব্য করেন। Untouchability and Stratification in Indian Civilisation নামক প্রবন্ধে দলিতদের সঙ্গে অস্পৃশ্যতার ধারণাটি জড়িত বলে দেখিয়েছেন।
বিংশ শতকের তিরিশের দশকে দলিত সম্প্রদায়ের জনগণ নিজেরা ঐ নামের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁদের নতুন নামকরণ হয় ‘ তপশিলি জাতি ‘ এবং ‘ তপশিলি উপজাতি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতে যে সংবিধান চালু হয়েছে, তাতে ১৯৩৫ সালের অভিধা গ্রহণ করা হয়েছে। আজও সরকারি ভাষ্যে দলিতরা তপশিলভুক্ত জাতি বা উপজাতি বলে উল্লিখিত হয়। যদিও তপশিলি সমাজের সব অংশ দলিত পর্যায়ভুক্ত নয়। দলিত‘ মূলত হিন্দুদের বিষয় হলেও মুসলমান, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মসম্প্রদায়ভুক্তদের মধ্যেও এই পর্যায়ের মানুষ দেখা যায়। যাঁরা দলিত শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী তাঁরা যুক্তি দেখান যে শব্দটি আন্দোলনের হাতিয়ার বিশেষ। লতা মুরুণকার মনে করেন, নানাভাবে চলত নিম্নবর্ণের অস্পৃশ্যদের ওপর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন। দারিদ্র্য ও দুঃখে এদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। উনিশ শতকের শেষার্ধে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে জ্যোতিরাও ফুলের নেতৃত্বে ধারাবাহিকভাবে বর্ণপ্রথাবিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। ফুলের জীবনীকার শ্রী ধনঞ্জয় কীয়ের ফুলেকে মহারাষ্ট্রের সমাজ বিপ্লবের পিতা‘ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত ফুলে ছিলেন আধুনিক ভারতের প্রথম ব্যক্তি যিনি সমাজের তথাকথিত নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের অর্থাৎ দলিতদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছিলেন। উনিশ শতকে যখন অধিকাংশ সমাজসংস্কার আন্দোলন মূলত শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন হিসাবে গড়ে উঠেছিল তখন ফুলে কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সত্যশোধক আন্দোলন ছিল গ্রামাঞ্চলভিত্তিক। মুকুন্দরাও পাটিলের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ফুলের মৃত্যুর পরেও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে থাকে।
মহারাষ্ট্রে অব্রাহ্মণ আন্দোলনের ক্ষেত্রে উনিশ শতকের শেষে দুটি সমান্তরাল ধারা দেখা যায় বলে গেইল ওমভেট মনে করেন। একটি ধারা ছিল রক্ষণশীল, গোঁড়া, যার পরিচালনায় ছিল অপেক্ষাকৃত ধনী ব্রাহ্মণরা অপরটি প্রগতিবাদী ধারা যার প্রতিনিধিত্ব করত সত্যশোধক সমাজ। পরিচালনায় ছিল অপেক্ষাকৃত ধনী ব্রাহ্মণরা। অপরটি প্রগতিবাদী ধারা, যার প্রতিনিধিত্ব করত সত্যশোধক সমাজ। দক্ষিণ ভারতে দলিতদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম পথপ্রদর্শক ছিলেন কেরলের শ্রীনারায়ণ । তাঁর সামাজিক আন্দোলনের বিশেষ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি না থাকলেও পরবর্তীকালে কেরালায় গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশে তা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আমরা মাদ্রাজের দিকে তাকালে দেখি মাদ্রাজের অন্ত্যজরা ব্রাহ্মণ বিরোধিতায় যতখানি না এগিয়ে এসেছিল তার থেকে অনেক বেশি এগিয়ে এসেছিল অব্রাহ্মণ জাতগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষিত এবং সম্পদশালী সম্প্রদায়। এমতাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ ভারতে যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে একাধারে জাতীয় আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনকে একটি মূল ধারায় মেলাতে চেয়েছিলেন তাঁর নাম ই. ভি… রামস্বামী নায়কার। যিনি ১৯২৫ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করে হিন্দুধর্ম, ব্রাহ্মণতন্ত্র এবং কংগ্রেসকে আক্রমণ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত “ আত্মমর্যাদা “ আন্দোলন ব্রাহ্মণ পুরোহিত ছাড়াই বিয়ে থেকে শুরু করে মন্দিরে জবরদস্তি প্রবেশ, মনুস্মৃতি পোড়ানো ও কখনও কখনও পুরোপুরি নিরীশ্বরবাদ পর্যন্ত এগিয়েছে। এম. এস. এস পণ্ডিয়ান দেখিয়েছেন, আত্মসম্মান আন্দোলন অনেক প্রত্যাশাপূর্ণ এক সমৃদ্ধিশালী সমাজের ধারণা উপস্থিত করেছিল, যে সমাজে থাকবে না কোনো জাতিগত প্রাধান্য, অস্পৃশ্যতা বা লিঙ্গ বৈষম্য। আম্বেদকার (১৮৯১–১৯৫৬) মহারাষ্ট্রের মাহার নামের অস্পৃশ্য শ্রেণীভুক্ত পরিবারে জন্মেছিলেন। তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলেন অস্পৃশ্যদের কতটা অপমান, উদ্বেগ, হতাশা এবং অবজ্ঞার অভিশাপ ভোগ করতে হয়। ১৯২০ – র দশক থেকে অস্পৃশ্য মাহাররা একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন আম্বেদকারের নেতৃত্বে। তাদের দাবির মধ্যে ছিল পৃথক প্রতিনিধিত্ব পুকুর ব্যবহার ও মন্দিরে ঢোকার অধিকার আর মাহারওয়াতন অর্থাৎ গ্রামের মোড়লদের জন্যে প্রথাগত বিভিন্ন সেবাকর্মের বিলোপ।
১৯২৭ সাল নাগাদ প্রথম মাহার রাজনৈতিক সম্মেলনের সময়েই হিন্দুধর্মের সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে বিচ্ছেদের প্রতীক হিসেবে । মনুস্মৃতি ‘ পোড়াতে শুরু করেন আম্বেদকারের কিছু অনুগামী। কংগ্রেস ১৯৩১ সালে করাচি অধিবেশনে সব নাগরিকদের জন্যে সমান অধিকার দাবি করেছিল। দলিতদের প্রতিনিধি হিসেবে আম্বেদকার গোলটেবিল বৈঠকে যান। সেখানে গান্ধির সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। সরকার দলিতদের জন্যে পৃথক নির্বাচনমণ্ডলীর ব্যবস্থা করলে গান্ধি অনশন করেন, ১৯৩২ সালে আম্বেদকার গান্ধীর সঙ্গে পুনা চুক্তি করে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলের ব্যবস্থা মেনে নেন 78 টি আসনের স্থলে গান্ধী এই শ্রেণীর জন্য ১৯১ টি আসনের ব্যবস্থা করেন পজেসি মন্ত্রিসভা গুলো বড় ধরনের সামাজিক সংস্কার চালু কআম্বেদকারের মৃত্যুর পর প্রকাশিত একটি চিঠির ভিত্তিতে ১৯৫৭ সালে রিপাবলিকান পার্টি গড়ে ওঠে। ঐ বছরেই বোম্বাই বিধানসভা নির্বাচনে তারা প্রার্থী দেয় ও কয়েকটি আসনে জয়লাভ করে। তবে দলের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত এবং অন্য কোনও কারণবশত ঐ পাটি অচিরে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই দলের বেশিরভাগ লোকই কয়েক বছরের মধ্যে কংগ্রেসে যোগ দেয় বা তার সঙ্গে জোট বাঁধে। ওয়াই. ভি. চহ্বান – এর নেতৃত্বে কংগ্রেস তাদের সাগ্রহে স্থান দেয়। ১৯৭০ এর দশকের প্রথম দিকে আমূল সংস্কারবাদী আন্দোলনের জোয়ার আসে দেশব্যাপী। তারই অঙ্গ হিসাবে মহারাষ্ট্রে দলিত প্যান্থার্স– এর উদ্ভব ঘটে। কুড়ি বছরের মধ্যে এদেরও প্রায় পরিসমাপ্তি ঘটলেও ভারতীয় রাজনীতির জটিল ধারায় দলিতদের বক্তব্য অন্যান্য রাজ্যেও কিছুটা ছড়িয়ে পড়ে। ঐ কাছাকাছি সময়েই পাঞ্জাবের নির্বাচনে দলিত নামের একটি সংগঠন অংশগ্রহণ করে। অকালিদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের সাফল্য না আসলেও কমপক্ষে একুশটা নির্বাচনী কেন্দ্রে তারা কংগ্রেস প্রার্থীদের পরাজয় সুনিশ্চিত করেছে। উত্তরপ্রদেশে প্রথমে কাঁসিরাম ও মায়াবতীর নেতৃত্বে বিংশ শতকের আশির দশক থেকে বহুজন সমাজ পার্টির উদ্ভব ঘটে। প্রথম দিকে দলিত আর পশ্চাদপদ জাতি ও সংখ্যালঘুদের একত্রিত করে একটি বহুজন সমাজ গঠনের কথা উঠেছিল বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে, বহুজন সমাজ পার্টি এমনই এক দলিত ভিত্তিক পার্টি যা ভোটের ভাগ বাড়ানোর জন্যে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়ার জন্যে যে কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গেই হাত মেলাতে পারে। যাইহোক উত্তরপ্রদেশ ছাড়াও পাঞ্জাব এবং মধ্যপ্রদেশে সিডিউল কাস্টের মধ্যে এই দল প্রভাব ফেলেছে। ওড়িশায় দলিত আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি থাকলেও তার সাংগঠনিক বিকাশ ঘটেনি। স্বাধীন ভারতে দলিতদের শক্তি বৃদ্ধির পেছনে অ দলিত, কিন্তু দলিতদের সমস্যাগুলির বিষয়ে চিন্তিত বিভিন্ন দল এবং গোষ্ঠীর ভূমিকা আছে। নানা দলের কৃষক – শ্রমিক ইউনিয়নগুলি আর কিছু নন– গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশনগুলি (NGO ) দলিতদের মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষক ও শ্রমিকদের মজুরিবৃদ্ধি, কাজের নিশ্চয়তা সংক্রান্ত কর্মসূচি চালু করার দাবি, কাজের অধিকার, বসবাসের জায়গা, শিশুশ্রম বিলোপ শিক্ষার অধিকার প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছে এইসব সংস্থা বা সংগঠনগুলো। এছাড়া কেবলমাত্র দলিতদের নিয়েও তৈরি হয়েছে বেশকিছু সংগঠন বা সংস্থা। গ্রামাঞ্চলে দলিত যুবারা আম্বেদকার সংঘ গড়ে তুলেছে। শহরাঞ্চলে ছাত্র, শিক্ষক যুবা এবং অফিসে কাজ করা মানুষদের সংঘ তৈরি হয়েছে। পরিশেষে উল্লেখ্য যে, দলিত দলগুলির এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির বহুচেষ্টা সত্ত্বেও এখনও বেশিরভাগ দলিতই কংগ্রেসকেই ভোট দেয়
4) ভারতে কৃষক আন্দোলনের উদ্ভব ও গতিপ্রকৃতি বর্ণনা করুন?
Answer – কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে জন সমষ্টি যখন বিরোধী হয়ে ওঠে তখন সেই অবস্থা কে বিদ্রোহ বলা হয়৷ সাধারণত ভারতীয় কৃষক বিদ্রোহের কারণ হিসাবে এই কাজ টি বেশ জোরালো ছিলো৷ কেননা বহুদিন ধরে উপনিবেশিক দের অত্যাচারে ভারতীয় কৃষক সমাজ জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। সেই কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দেশীয় কৃষক রা বিদ্রোহী হয়ে পড়ে, সাথে সাথে দেখা দেয় কৃষক বিদ্রোহ। উত্তর–স্বাধীন ভারত সাম্প্রতিক অতীতে ব্যাপকভাবে দুই ধরনের কৃষক বা কৃষকদের সংগ্রাম দেখেছে। মার্কসবাদী ও সমাজবাদীদের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন– যেমন তেলেঙ্গানা আন্দোলন (1946-51), তেবাধা আন্দোলন ( 1946-1949), কাগোড়ু সত্যাগ্রহ (1951), নকশালবাড়ি আন্দোলন (1967) এবং লালগড় আন্দোলন (2009) | ভারতের চলমান কৃষক আন্দোলন ইতোমধ্যেই দেশ–বিদেশের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আলোচনা–উত্তেজনা, তর্ক– বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই আন্দোলন৷ আমরা জানি এর ভেতরেই অনেক প্রবন্ধ–নিবন্ধ, রাজনৈতিক ধারাভাষ্য লেখা হয়েছে এই আন্দোলন নিয়ে আমি মনে করি, ভারতের চলমান এই আন্দোলন বুঝতে হলে ভারতে সংগঠিত অতীতের বড় কৃষক বিদ্রোহগুলোর আখ্যানও স্মরণ করা প্রয়োজন। আর ভারতের তিনটি প্রদেশ এবং বিশেষত: পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকেরা ও শিখ কৃষকেরা এই আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকায় অতীতেও শিখ কৃষকেরা তাদের ধর্মগ্রন্থ ও গুরুদের আদেশে ফসলের অধিকারের প্রশ্নে লড়েছেন, সেই দিকটিও খানিকটা বিশ্লেষণ করে ভারতের ইতিহাসে অতীতের কৃষক বিদ্রোহ: ভারতে অবশ্য এটাই প্রথম কৃষক আন্দোলন বা বিক্ষোভ নয়৷ অতীতেও ভারতে বড় বড় কৃষক বিদ্রোহ বা আন্দোলন ঘটেছে৷ নিচে ছয়টি বড় ভারতীয় কৃষক বিদ্রোহের কথা সংক্ষেপে নথিবদ্ধ করা হলো;
১. চম্পারণ সত্যাগ্রহ (১৯১৭): চম্পারণ কৃষক আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনেরই একটি অংশ ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরার পর গান্ধিজি বিহারের চম্পারণ এবং গুজরাটের খেদায় কৃষকদের ভেতর পরীক্ষামূলকভাবে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলেন। মূল লক্ষ্য ছিল কৃষকদের সংগঠিত করে তোলা। বিহারের চম্পারণে বৃটিশ শাসকদের জোর করে চাপিয়ে দেয়া নীল চাষ, কৃষিজমির উপর খাজনা বাড়িয়ে দেয়া, জমিদারের খেয়ালখুশি মাফিক ফসল চাষের জন্য কৃষককে তার জমির সেরা অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা, কৃষি মজুরির অত্যধিক নিম্নহার ও প্রবল দারিদ্র্য কৃষকদের বাধ্য করেছিল বিক্ষুব্ধ হতে। তবে কৃষকেরা শেষপর্যন্ত গান্ধির অসহযোগের বাণীতে স্থির থাকতে পারেনি এবং আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। এতে গান্ধি নিজে বিক্ষুব্ধ হন। কিন্তু, দরিদ্র কৃষকের পক্ষেই বা কতটুকু অহিংস থাকা সম্ভবপর ছিল? বৃটিশ সরকার কঠোর হাতে এই আন্দোলন দমন করলেও, এই আন্দোলনের অগ্নি–স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে৷
২. খেদা কৃষক সংগ্রাম: গুজরাটের মধ্যভাগে অবস্থিত খেদা‘ অঞ্চল তামাক ও সূতা চাষে তার মৃত্তিকার উর্বরতার জন্য বিখ্যাত৷ এখানে পাতিদার নামে পরিচিত কৃষকেরা চাষের জন্য বংশ–পরম্পরা ধরে পরিচিত। কিন্তু বৃটিশ সরকারের বাড়িয়ে দেয়া জমির খাজনা, খেদায় সহসা দেখা দেওয়া এক দূর্ভিক্ষ এবং দূর্ভিক্ষের ভেতরেও বৃটিশ সরকারের খাজনা মওকুফ না করা, খাজনা প্রদানে অক্ষম চাষীর ফসল ও গৃহপালিত গবাদিপশু জব্দ করায় ক্ষুব্ধ চাষীরা গান্ধিজি, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, এন.এম.যোশি প্রমুখ নেতার নেতৃত্বে খেদা সত্যাগ্রহ গড়ে তোলেন। সরকার পরে কৃষকদের কিছু দাবি–দাওয়া মেনে নিলে আন্দোলনটি স্তিমিত হয়।
৩. গুজরাটের বারদোলি কৃষক আন্দোলন: ১৯২৫ সালে গুজরাটের বারদোলিতে প্রবল বন্যায় ফসল ধ্বংস হয়ে দূর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং কৃষকেরা ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। এই দুঃসময়েও বম্বে প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ সরকার গুজরাটে ৩০ শতাংশ খাজনা বাড়ায়। নাগরিকদের নানা আবেদন–নিবেদনেও তাদের কথা শোনা হয় না। তখন নরহরি পারিখ, রবি শঙ্কর ব্যাস এবং মোহনলাল পান্ডা– গ্রামীণ নেতাদের সাথে আলাপের প্রেক্ষিতে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের সাথে কথা বলেন৷ প্যাটেল গুজরাটি কৃষকদের আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রেরণা যোগান৷ কৃষকেরা সরকারকে খাজনা দিতে অসম্মত হলে বৃটিশ সরকার উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে পাঠান যোদ্ধাদের আনিয়ে নিরীহ কৃষকদের ঘর–বাড়ি ভেঙ্গে দিলেও; কৃষকেরা অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যান। জনতার সম্মিলিত, অহিংস প্রতিরোধে বিচলিত বৃটিশ সরকার একসময় কৃষকদের কেড়ে নেওয়া জমি ফেরত দিতে বাধ্য হন এবং জমির ৩০ শতাংশ বর্ধিত খাজনা মওকুফ করা হয়।–
৪. মালবারের মোপলাহ বিদ্রোহ: মালবারের মোপলাহ– মুসলিম কৃষকেরা কেরালার মালাবারে বংশ পরম্পরায় বাস করতেন। মোপলাহ মুসলিমদের ভেতর কিছু ধনী ব্যবসায়ী থাকলেও অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র কৃষক এবং এই কৃষকদের জমিদাররা ছিলেন আবার উচ্চবর্ণ হিন্দু। ১৯২১ সালের আগস্টে মোপলাহ কৃষকেরা আন্দোলন শুরু করে৷ আপাতঃদৃষ্টে মোপলাহ কৃষকদের আন্দোলন হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে মনে হলেও জমির চড়া খাজনার বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল৷ অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দ্বিবিধ পার্থক্য থেকে আন্দোলনটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে। আসলে হিন্দু জমিদাররা ১৮৩৫ সাল থেকে মোপলাহ কৃষকদের নানা অধিকার খর্ব করতে থাকেন। বর্ণহিন্দু জমিদার বা জেনমিরা প্রতিবছর জমির কর বাড়াতেন এবং কৃষকদের জমি যখন–তখন কেড়ে নেওয়া হতো৷ হিন্দু জমিদার বা জেনমিরা যদিও হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকদেরই শোষণ করতেন, তবে মুসলিম কৃষকদের আরো বেশি শোষণ করা হতো৷ ঠিক এসময়েই সারা ভারতে মুসলিমদের ভেতর খিলাফত আন্দোলন বিস্তার লাভ করলে মোপলাহ কৃষকেরা আরো ক্ষুব্ধ হয়৷ তবে একটা পর্যায়ে কৃষকদের এই বিদ্রোহ খুব বেশি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার চেহারা নিলে এই আন্দোলন হিন্দু কৃষকদের সমর্থন হারায়। আন্দোলনে বাড়তে থাকা সহিংস উত্তেজনার কারণে বৃটিশ সরকার ১৯২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ আন্দোলন দমন করতে সমর্থ হন।
৫. তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহ: ভারতের ইতিহাসের বলতে গেলে সবচেয়ে রক্তাক্ত এই কৃষক বিদ্রোহে ২,০০০ কৃষক মারা পড়েছিলেন এবং ২৫,০০০ কম্যুনিস্ট গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। হায়দ্রাবাদের নিজাম পরিচালিত সামন্ততান্ত্রিক জমি চাষ পদ্ধতিতে প্রকৃত কৃষকদের কোন অধিকারই ছিল না। অধিকার ছিল খালসা জমি থেকে খাজনা আদায়কারী দেশমুখ ও দেশপান্ডেদের তেলেঙ্গানার মূল বাণিজ্যিক ফসল যেমন সুপারী ও তামাক চাষের জমিগুলো ছিল ব্রাহ্মণদের হাতে। রেড্ডি ও অন্যান্য কৃষকেরা উচ্চবর্ণদের হাতই শক্ত করেছে৷ তবে, একটা সময় জমির মালিকানা আরো বেশি বেশি ব্রাহ্মণ, মাড়ওয়ারি, অভিজাত মুসলিম ও বৈশ্যদের হাতে চলে যেতে থাকে; যারা গ্রামেই বাস করতেন না এবং জমির সাথে তাদের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। সাধারণ কৃষকদের অধিকার ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকলে তারা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে দূর্ণিবার সংগ্রাম গড়ে তুললেও কঠোর পন্থায় এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।
৬. বাংলার তেভাগা আন্দোলন: বর্গাদার কৃষকের জন্য জমির দুই–তৃতীয়াংশ ফসলের দাবিতে বাংলার কৃষকেরা গড়ে তুলেছিলেন তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬–৪৭ সালে মূলত: উত্তর বাংলার কৃষকেরাই সবচেয়ে বেশি সংগঠিত হয়েছিলেন। দেখতে দেখতে বাংলার ১৯টা জেলায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রবল পুলিশী দমন–পীড়ন ও বাংলা ভাগের কারণে আন্দোলনটি একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে।
5) কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য লিখো ?
Answer :- কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য (The Peasants Movements in the Twentieth Century):- বিশ শতকের ভারতে সংঘটিত কৃষক আন্দোলনগুলি পর্যালোচনা করলে আন্দোলনগুলির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন–
(১) বেশকিছু কৃষক আন্দোলন প্রথমদিকে ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরে সেগুলি জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ–বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। পরিশেষে এই সমস্ত আন্দোলনগুলি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতামূলক আন্দোলনে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে পাগলপন্থী আন্দোলন, ফরাজি আন্দোলন ও ওয়াহাবি আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যায়।
(২) কৃষক আন্দোলনগুলির উৎসস্থল ছিল গ্রামাঞ্চল, বেশিরভাগ কৃষক আন্দোলনগুলি গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এইসব আন্দোলনগুলি অসংগঠিত প্রকৃতির ছিল এবং আন্দোলনগুলি বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন ও ইতস্ততভাবে শুরু হয়েছিল।
(৩) জাতীয়তাবাদী আদর্শের ওপর ভিত্তি কৃষকদের কোনো আন্দোলন শুরু হয়নি। জমির মালিকানা আদায়ের জন্য বা জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটানোর জন্যও তারা আন্দোলন সংঘটিত করেনি। জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষন এবং ব্রিটিশদের উচ্চহারে অবৈধ খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে ছিল তাদের প্রতিবাদী আন্দোলন।
(৪) কৃষক আন্দোলনগুলি অঞ্চলবিশেষে সীমাবদ্ধ ছিল। এক অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ থাকত না। আন্দোলনগুলিকে কেন্দ্র করে কৃষকদের মধ্যে সাময়িকভাবে যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে উঠেছিল, আন্দোলনের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনগুলির অবসান ঘটে।
(৫) কৃষক বিদ্রোহগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমিদার, মহাজন, সামস্তগোষ্ঠী এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। আবার দেখা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশকিছু জমিদার বা সামন্তপ্রভু কৃষ্ণকবিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং তারা কৃষকবিদ্রোহে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। বেশিরভাগ কৃষক আন্দোলনগুলিতে দেখা যায় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থেকেই কোনো সাধারণ কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
6) ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে সৈয়দ আহমেদ খানের দৃষ্টিভঙ্গি একটি মূল্যায়ন করুন?
Answer – সৈয়দ আহমেদ সমাজে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানোর জন্য যে সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন তা ইতিহাসে আলিগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথমদিকে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক মােটেই ভালো ছিল না। ব্রিটিশ সরকার মহাবিদ্রোহের জন্য মুসলিমদের বেশি দায়ী করেছিল। অপরদিকে, মুসলমানরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনকে সন্দেহের চোখে দেখত। আলিগড় কলেজের অধ্যক্ষ থিয়োডোর বেকের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সৈয়দ আহমেদ খান পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের নিয়ে আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করে এক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ ।
মুসলিম সংস্কারক :- 1850-এর দশকে, সৈয়দ আহমদ খান শিক্ষার প্রতি একটি শক্তিশালী আবেগ গড়ে তুলতে শুরু করেন। ইউরোপীয় আইনশাস্ত্র সহ বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করার সময়, স্যার সৈয়দ পাশ্চাত্য–শৈলীর শিক্ষার সুবিধাগুলি উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন, যা ভারতজুড়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলিতে দেওয়া হচ্ছিল। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও, স্যার সৈয়দ ঐতিহ্যগত গোঁড়ামি এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রভাবের সমালোচনা করেছিলেন, যা বেশিরভাগ ভারতীয় মুসলমানদের ব্রিটিশ প্রভাবের প্রতি সন্দেহজনক করে তুলেছিল। [স্যার সৈয়দ মুসলিম সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন বোধ করতে শুরু করেন। মুঘল আভিজাত্যের একজন বংশধর, স্যার সৈয়দ মুসলিম অভিজাত সংস্কৃতির সর্বোত্তম ঐতিহ্যে লালিত–পালিত হয়েছিলেন এবং ভারত জুড়ে মুসলিম রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্রমাগত পতন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। 1857 সালের ভারতীয় বিদ্রোহের আগে এবং পরে ব্রিটিশ এবং মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ বহু প্রজন্ম ধরে ভারত জুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রান্তিক করার হুমকি দিয়েছিল।
রাজনৈতিক ধারনা :-“একটি রাজনৈতিক জীবনী “ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে স্যার সৈয়দ সর্বাগ্রে একজন শিক্ষাবিদ এবং সংস্কারক ছিলেন এবং একাডেমিক চিন্তাবিদ ছিলেন না, এবং তাই তার রাজনৈতিক দর্শন তার সময়ের পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত। তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে রুপদানকারী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ, ইংল্যান্ডে উইলিয়াম ইওয়ার্ট গ্ল্যাডস্টোনের প্রধান পদ (যা শুরু হয়েছিল ১৮৬৮ সালে) এবং ভারতে লর্ড রিপনের ভাইসরয়্যালিটি।
স্যার সৈয়দ গভীরভাবে ধার্মিক ছিলেন। তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইসলাম এবং একটি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি কেন্দ্রিক।
1878 সালে, স্যার সৈয়দ ভাইসরয়ের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মনোনীত হন। তিনি শিক্ষা কমিশনের সামনে ভারত জুড়ে আরও কলেজ ও স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য সাক্ষ্য দেন। তার রাজনৈতিক কর্মজীবনের শুরুতে, স্যার সৈয়দ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং ভারতের যৌথ সংস্কৃতির একজন প্রবক্তা ছিলেন , সমস্ত ভারতীয়দের ক্ষমতায়ন করতে চেয়েছিলেন। একই বছরে, স্যার সৈয়দ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সহযোগিতার জন্য মুহামেডান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। 1886 সালে, তিনি আলীগড়ে অল ইন্ডিয়া মুহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের আয়োজন করেন, যা মুসলমানদের জন্য আধুনিক শিক্ষা এবং রাজনৈতিক ঐক্যের তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে। তার কাজগুলি তাকে 19 শতকের ভারতের সবচেয়ে বিশিষ্ট মুসলিম রাজনীতিবিদ করে তোলে, প্রায়শই বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে মুসলমানদের মনোভাবকে প্রভাবিত করে।
আলিগড় আন্দোলনের প্রসার
[1] আলিগড় কলেজের ভূমিকা: আলিগড় কলেজের প্রথম তিন অধ্যক্ষ থিয়োডোর বেক, টি. মরিসন, ডব্লিউ.এ.জে. আর্চিবল্ড প্রমুখ আলিগড় কলেজকে আন্দোলনের মূলকেন্দ্রে পরিণত করেন। অধ্যক্ষ থিয়োডোর বেক সম্পাদক ইন্সটিটিউট গেজেট নামক কলেজ পত্রিকাটির দ্বারা বাঙালি, হিন্দু ও কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়।
[2] বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা: জাতীয় কংগ্রেসের বিকল্প রূপে আলিগড়ে বেকের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮৮৮ খ্রি.)। থিয়োডোর বেক পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন অব আপার ইন্ডিয়া (১৮৯৩ খ্রি.)।
[3] সৈয়দ আহমেদ ও শিক্ষাসংস্কার: মুসলিমদের উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য উর্দু পত্রিকা ‘তাহজিব–উল–আকলার্ক‘ ও ‘পাইওনিয়ার’ পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিমদের প্রতি পাশ্চাত্য শিক্ষার ভাবধারা প্রচারিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞান সমিতি (১৮৬৫ খ্রি.) ও অনুবাদ সমিতি (১৮৬৬ খ্রি.)। স্যার সৈয়দ আহমেদ গাজীপুরে প্রতিষ্ঠা করেন একটি ইংরেজি বিদ্যালয় (১৮৬৪ খ্রি.), সায়েন্টিফিক সোসাইটি (১৮৬৫ খ্রি.), কমিটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব লার্নিং অ্যামং দ্য মহামেডান অব ইন্ডিয়া (১৮৭০ খ্রি.), অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (১৮৭০ খ্রি.), যা পরবর্তীকালে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পায় (১৯২০ খ্রি.)।
[4] সৈয়দ আহমেদ ও সমাজসংস্কার: সৈয়দ আহমেদ সে সময়কার মুসলিম সমাজে প্রচলিত তালাক প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিভিন্ন কুপ্রথার বিরুদ্ধে মুসলিমদের সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। তিনি বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও যুক্তিবাদের আলোকে মুসলিম সমাজের আধুনিকীকরণের চেষ্টা চালান। এমনকি তিনি আধুনিক চিন্তা ও যুক্তিবাদের আলোকে কোরানের ব্যাখ্যা দেন। মুসলমান সমাজের রক্ষনশীলতার বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘােষনা করেন।
স্যার সৈয়দ আহমদের সংস্কারগুলির প্রধান উদ্দেশ্য :– স্যার সৈয়দ আহমদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান সমাজের অগ্রগতি ঘটানো। তিনি মুসলিম সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত ও আধুনিক করে তোলার প্রচেষ্টা করেছিলেন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চা জনপ্রিয় করার জন্য তিনি উদ্যোগ নেন। আধুনিক যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের বই উর্দু ভাষার অনুবাদ করা হয়। যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে তিনি কোরানকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। পুরোনো প্রথা ও যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধেও তিনি মতপ্রকাশ করেন।
7) সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদী চিন্তার বৈশিষ্ট্য গুলি বিশ্লেষণ করুন?
Answer – সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদ জাতীয়তাবাদের ধারণা জাতীয়তাবাদী নেতা:– নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন আপাদমস্তক ভারতীয় জাতীয় নেতা। তাঁর জাতীয়তাবাদী ধর ছিল আপসহীন ও সুদৃঢ়। সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী চিন্তা ভাবনার অভিব্যক্তি ঘটেছে বিভিন্ন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে তাঁর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভাবনা, বক্তব্য ও আন্দোলনমূলক কার্যকলাপ বিশেসাভারে উল্লেখযোগ্য। সুভাষচন্দ্রের রাজনীতিক মতাদর্শের মূল বিষয় ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে আপনার সংগ্রাম এবং ভারত ও ভারতবাসীর স্বাধীনতা এবং এ বিষয়ে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে বাস্তবাট স্বভাবতই সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রামাণ্য পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর স্বদেশ ও স্বজনপ্রীতি এ স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে। ভারতের রাজনীতিক স্বাধীনতা এবং ভারতীয়দের গণতান্ত্রিক অধিকারসার আদায়ের সংগ্রামের তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। বিদেশী ব্রিটিশ শাসকদের বিরু ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ ধ্যান– –ধারণার অবিমিশ্র অভিব্যক্তি ঘটেছে। সুভাষ্কন্দ্রের লেখা The Indian Struggle শীৰ্বক হয় এবং তাঁর মতামত ও বক্তৃতা সম্বলিত তরুণের স্বপ্ন শীৰ্বক গ্রন্থটি সূত্রে সুভাশ্চন্দ্রের জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ও কার্যকলাপের পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে সুভাবচন্দ্রের ঠাঁই ভারতীয়দে মনের মণিকোঠায়। অধ্যাপক ড. বিশ্বনাথ প্রসাদ ভর্ম (V.P.Varma ) তাঁর Modern Indian Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেনঃ “ As a political worker and leader, Bose stood fours strengthened nationalism. Patriotism was the assence of his personality and the supremie expression of his soul. Hence in his writings one finds a repeated emphasis on an ol absorbing nationalism. ” জাতীয়তাবাদী সুভাষচন্দ্র ভারতীয়দের হীনম্মন্যতা কাটিয়ে উঠার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর অভিমত অনুয়া ইউরোপীয় জাতিগুলি অধিকতর উন্নতা, এ রকম একটি দৃঢ়মূল ধারণা বা মনোভাবের জন্যই ভারতীয়দের পরাধীনতার গ্লানি সহ্য করতে হচ্ছে। ভারতের তিরিশ কোটি মানুষ মুষ্টিমেয় ইংরেজদের দ্বারা শাসির হচ্ছে। এর থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার হতে পারে না। ভারতের জনসাধারণ নির্মিত সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনকে স্বীকার ও সমর্থন করেছে এবং করছে। তাই ব্রিটিশ সরকার বহাল বর্তমান।
প্রভুত্বকারী ইংরেজদের প্রতি অনুগ মোহ কাটলে স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যোগ – আয়োজন তীব্রতর হলে এবং সহায়ক স্বীকৃতি ও সমর্থন প্রত্যাহৃত হলে ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের নাভিশ্বাস উঠবে। ভারত পালাতে তারা বাধ্য হবে। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যত তাড়াতাড়ি প্রসারিত হয়েছে, ততোধিক অপসারিত হবে। সুভাষচন্দ্র এক জনসমাবেশে তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন যে, আমরা ভারতীয়রা আত্মশক্তিতে আস্থাশীল নয় অথচ ভারতীয়দের অতীত অতিমাত্রায় গৌরবজ্জ্বল৷ আমরা আমাদের আলোকিত অতীত সম্পর্কে বিস্তৃত এই বিস্মৃতিই আমাদের অধঃপতনের মূল। মহিমান্বিত অতীতকে স্মরণ করলে ভারতীয় আস্থাশাল নই। অথচ ভারতীয়দের অতীত অতিমাত্রায় গৌরবোজ্জ্বল। আমরা আমাদের আলোকিত অতীত হিসাবে আমাদের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হবে। অতীতের গৌরবানুভূতি জাতি হিসাবে আত্মশক্তিতে আমাদের আস্থাশীল করে তুলবে। এবং অনতিবিলম্বে পরাধীনতার গ্লানি থেকে ভারত ও ভারতবাসী মুক্তি পাবে। সুভাষচন্দ্রের এই প্রত্যয় হল তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ। অধ্যাপক ড. ভর্মা মন্তব্য করেছেন : “ In his political activities both in India and outside Bose always stood up as a valiant spokesmen of a nationalism that gave no concession to any communalism. “
সুভাষচন্দ্রের অভিমত অনুযায়ী সুযোগ – সুবিধার স্বার্থে কৌশলের নীতি অনুসরণ করলে জাতি গঠন সম্ভব না। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের বাণীর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। স্বামীজি বলেছেন যে, আত্মত্যাগ সুভাষচন্দ্র ব্যতিরেকে কোন কিছু অর্জন করা অসম্ভব। সুভাষচন্দ্র রাজনীতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চূড়ান্ত আত্মত্যাগের অপরিহার্যতার কথা বলেছেন। The Indian Struggle গ্রন্থে সুভাষচন্দ্র বলেছেন যে, দেশব্যাপী জনসাধারণ যখন প্রচণ্ড উন্মাদনায় উজ্জীবিত, তখন সকলে আশা করেছিল যে, জাতীয় কংগ্রেস সাহসের সঙ্গে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবে। জনসাধারণ যখন তৈরী ছিল, কংগ্রেস এবং নেতারা তখন প্রস্তুত ছিলেন না। সারা দেশে প্রচার চালিয়ে সুভাষচন্দ্র এই ধারণা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট ছিলেন যে কংগ্রেসকে বিকল্প সরকারের ভূমিকা পালন করতে হবে। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের পন্থা পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন।
কংগ্রেসের চিন্তা – ভাবনাকে অধিকতর মৌলিক ও গঠনমূলক করতে চেয়েছিলেন এবং কংগ্রেসের ভূমিকাকে অধিকতর আক্রমণাত্মক করতে চেয়েছিলেন। জাতীয় সংগঠনকে ছাত্র যুব নারী জাতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহ প্রভৃতি সকলের মধ্যে সম্প্রসারিত করার করে ব্যাপারে সুভাষচন্দ্রের সদিচ্ছা ছিল। জাতীয় আন্দোলন পরিচালনার জন্য ধর্মঘট ও আইন অমান্য আন্দোলনের পথে এগোতে হবে। দেশের জনসাধারণ যখন বিদেশী সরকারের দাসত্বশৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হবে এবং স্বাধীনতার জন্য সর্বপ্রকার মরণপণ সংগ্রামের সামিল হবে তখনই স্বরাজ অর্জন সম্ভব হবে। অন্যথায় ব্রিটিশ দ্রব্যসামগ্রী বয়কট করে, চরকা কেটে বা আইনসভায় যোগ দিয়ে সম্পূর্ণ স্বরাজ পাওয়া বাদ যাবে না।
জাতীয় আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধীর উপায় – পদ্ধতি সুভাষচন্দ্র স্বীকার বা সমর্থন করেন নি বা করতে পারেন নি। গোল টেবিল বৈঠকে গান্ধীজির ভূমিকা সুভাষচন্দ্রকে উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত করেছে। পরিস্থিতির মোকাবিলায় মহাত্মার সহজ সরল খোলামেলা আচরণ সুভাষচন্দ্রের মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। তিনি গান্ধীজির মধ্যে রাজনীতিক ক্ষমতার দৃঢ়তা এবং উজ্জীবিত ভূমিকা আশা করেছিলেন। তার The Indian Struggle শীর্ষক গ্রন্থে সুভাষচন্দ্র বলেছেন : ” If the Mahatma had spoken in the language of Dictator Stalin, of Duce Mussolini or Fuhrer Hitler, John Bull would have understood and bowed his head in respect. ” সুভাষচন্দ্র স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর স্বাধীনতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। স্বামীজির মত সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতাকে ইহজীবনের অমৃত সুধা এবং আত্মার সঙ্গীত হিসাবে গণ্য করেছেন। তাঁর কাছে। স্বাধীনতা হল এক সীমাহীন সম্পদ, মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। মানুষের আত্মার স্বাধীনতাকে তিনি মানবদেহের জন্য অক্সিজেনের মতই অপরিহার্য প্রতিপন্ন করেছেন।
সুভাষচন্দ্র ভারতের মানুষকে জ্ঞানে পরিমায় ঐশ্বর্যমণ্ডিত অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি এই আশা পোষণ করেছেন যে, ভারতীয়রা অনতিবিলম্বে অতীতের আত্মগরিমা অনুভব করবে, জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত হবে এবং নিজেদের জাতীয় ভাগ্যের নিয়ত্তা হবে। সুভাষচন্দ্রের বাসনা ছিল যে ভারত তার নিজের জাতীয় পতাকা ও সামরিক বাহিনীর অধিকারী হবে এবং পৃথিবীর সকল স্বাধীন দেশের রাজধানীতে ভারতের রাষ্ট্রদূত পাঠাবে। তিনি এই আশা প্রকাশ করেছেন যে অদূর ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ সকল স্বাধীন জাতির মধ্যে নিজেকে উন্নত মস্তিষ্কে জাহির করবে। ভারতবর্ষ ও ভারতবাসী সাম্রাজ্যবাদী শাসন শোষণের শৃঙ্খল ভেঙ্গে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার অধিকারী হবে। অধ্যাপক ড. ভর্মা বলেছেন: “ Due to his burning from the chams of British imperialism and his intense suffering in the cause of the patriotism, his almost fanatical devotion to the ideal of the emancipation of the country nation, Bose will be hailed as a national hero of the front rank . ” বাহিনী গঠন করেছেন। এই বাহিনী হল তাঁর বিপ্লবী সংগঠন। বিদেশে তিনি আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠিত স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর স্বাধীনতার স্বার্থে সুভাষচন্দ্র দেশত্যাগ করেছেন। বিদেশে তিনি আজাদ হিন্দ করেছেন। এ হল স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার বা বিপ্লবী সরকার।
8) ‘নয়া মানবতা‘ প্রসঙ্গে এম. এন. রায়ের ধারণা আলোচনা করুন?
Answer – মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদ ( New Humanism of Manabendranath ) জীবন ও মননের শেষ সমগ্র কর্মজীবন জুড়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রাজনীতিক চিন্তা অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয় নি। কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানবেন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তায় মৌলিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তার জীবন ও মননধারা বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। এবং এ ক্ষেত্রে তিনটি পৃথক পর্যায় পরিলক্ষিত হয়। মানবেন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তায় এটি একটি বড় বৈশিষ্ট্য। কর্মজীবনের গোড়ার দিকে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী। পরবর্তীকালে তিনি মার্কসবাদী দর্শনে দীক্ষিত হন। এবং কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে পর্যায় নয়া মানবতাবাদ মানবেন্দ্রনাথ নয়া মানবতাবাদী দর্শনের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত হন। মানবেন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বিশেষভাবে সমৃদ্ধ । সমগ্র জীবনব্যাপী মানবেন্দ্রনাথ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সমকালীন পৃথিবীতে তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ। মানবেন্দ্রনাথের অনন্য অভিজ্ঞতা ও প্রখর পাণ্ডিত্য পরিণতি লাভ করেছে তাঁর নয়া মানবতাবাদী দর্শনে। মানবেন্দ্রনাথের জীবন ও মননধারার পিছনে একটি পটভূমির ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। বিষয়ে মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদী দর্শনে উপনীত হওয়ার কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক। মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদী দর্শনে উপনীত হওয়ার পিছনে বিবিধ কার্য কারণ বর্তমান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর কর্মজীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁকে নয়া মানবতাবাদী আদর্শের অনুগামী করেছে। তা ছাড়া সমকালীন বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাও এ ক্ষেত্রে মানবেন্দ্রনাথের মননকে প্রভাবিত করেছে। বিভিন্ন দিক থেকে বিষয়টির বিচার বিশ্লেষণ বাঞ্ছনীয়। মানবেন্দ্রনাথ মানবসভ্যতার সমকালীন নয়া মানবতাবাদ সৃষ্টির সংকটের সমাধানস্বরূপ নয়া মানবতাবাদী দর্শনকে হাজির করেছেন। মানবতার সংকট মানবেন্দ্রনাথকে শংকিত করেছে। মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের অতিপ্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ মানবেন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন। রাজনীতিক দলীয় ব্যবস্থার সীমাবব্ধতা সম্পর্কে তিনি সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ও অমানবিক পরিণতি মানবেন্দ্রনাথকে বিচলিত করেছে। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে মানবেন্দ্রনাথ জীবন সায়াহ্যে নতুন এক দার্শনিক পথের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করেন। এইভাবে। দার্শনিকের পর্যায়ে উন্নীত হন। মানবেন্দ্রনাথের রাজনীতিক জীবনের বেশ একটি বড় অংশ সমাজতান্ত্রিক ও একসময় মার্কসবাদে মানবেন্দ্রনাথের দীক্ষা হয়। তিনি লেনিনসহ সমকালীন বিশ্বের বিশিষ্ট মার্কসবাদী। সাম্যবাদী মতাদর্শের বিকাশে ও বিস্তারে ব্যয়িত হয়। কিন্তু মানবেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বাধীনতার পুজারী।। চিন্তার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই স্বাধীন চিন্তার অনিয়ন্ত্রিত অভিব্যক্তির উপর তিনি বিশেষ জোর দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন যে, সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা কার্যত অস্বীকৃত। গোষ্ঠীও সমাজবাদী সমাজে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। সকলের স্বাধীনতা ভোগ সুনিশ্চিত হবে এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদ তিনি বুদ্ধিজীবী অনুভব করেন। বস্তুত কমিন্টার্নের সদস্য থাকাকালীন সময়ের শেষের দিকে মানবেন্দ্রনাথের মনে নতুন এক জীবনদর্শনের বীজ উদ্দীপিত হয়। এই বীজ ক্রমশ অঙ্কুরিত পল্লবিত হয়। মানবেন্দ্রনাথের মার্কসবাদী জীবনধারার সমাপ্তি ঘটে। কর্মজীবনের এই শেষ পর্যায়ে তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নতুন আদর্শকে অবলম্বন করেন। এই নতুন আদর্শই নয়া মানবতাবাদী দর্শন হিসাবে পরিচিত হয়। পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে মানবেন্দ্রনাথ বহু দিন কাটিয়েছেন। গণ প্রজাতন্ত্রী চীনেও তিনি অনেকদিন অতিবাহিত করেছেন। মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার চেহারা চরিত্র একেবারে কাছ থেকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। । পরবর্তীকালে মানবেন্দ্রনাথ মার্কসবাদ ও সোভিয়েত সমাজবাদী সমাজব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহ সবিস্তারে পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কথা ঠিক । কিন্তু সেখানে সবকিছু কমিউনিস্ট পার্টির মুষ্টিমেয় কিছু নেতার নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক পথে সমাজবাদের আগমনকে সেখানে উৎসাহিত করা হয়নি। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতা বিপন্ন। মার্কসীয় দর্শনের সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদী দর্শনের পার্থক্য প্রসঙ্গে অন্যান্য বিষয়ের উল্লেখ আবশ্যক। সমাজবাদের সীমাবদ্ধত মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে সমাজের প্রয়োজনের তাগিদে ও স্বাভাবিক নিয়মে শিক্ষা সংস্কৃতি, নীতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত ধ্যান ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। কিন্তু মার্কসীয় দর্শন অনুসারে এই সমস্ত ধ্যান ধারণা হল সংশ্লিষ্ট সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থারই অভিব্যক্তি। আবার মার্কসীয় দর্শনের আর্থনীতিক নির্দেশবাদকে মানবেন্দ্রনাথ সত্য বলে স্বীকার করেন নি। মানবেন্দ্রনাথের অভিমত অনুযায়ী মানুষই সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। মানুষের মনন এবং ইচ্ছাশক্তির সৃষ্টি হয় সংশ্লিষ্ট আর্থনীতিক ব্যবস্থার অনুপ্রেরণা থেকে। মানবেন্দ্রনাথ সমগ্র জগতের পারিপার্শ্বিক অবস্থার অংশ হিসাবে মানুষের মনকে বিচার – বিবেচনা করেছেন। মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে এটাই হল বস্তুবাদের মূল বিষয়। তাঁর অভিমত অনুযায়ী কমিউনিস্ট শাসিত সমকালীন রাষ্ট্রসমূহে ব্যক্তি – মানুষ মুক্তির স্বাদ পায় নি। সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপর কর্তৃত্ব কায়েম, ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান এবং উৎপাদন উপাদানসমূহে সামাজিক মালিকানা কায়েম করলে মুক্ত সমাজের সৃষ্টি সুনিশ্চিত হয় না। এ বিষয়েও মার্কসবাদের সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পুঁজিবাদের সীমাবদ্ধতা আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি প্রভৃতি দেশে অবস্থানকালীন সময়ে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং পার্লামেন্টীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আকৃতি প্রকৃতির সব কিছু সম্যক ভাবে অনুধাবন করেছেন। মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়ে সাড়ম্বর তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে পুঁজিবাদী সমাজে বাছাই করা কিছু মানুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার অবহেলিত হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজের মৌলিক সমস্যাসমূহের সম্যক সমাধান সম্ভবপর নয়। আবার দ্বৈরী শক্তিসমূহের অভ্যুত্থান এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অমানুষিক অত্যাচার সমকালীন বিশ্বে বিপদ হিসাবে দেখা দেয়। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ রকম পরিস্থিতিতে সমাজজীবন থেকে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে অপসারিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বিকল্প ব্যবস্থা। হিসাবে গণতান্ত্রিক পথে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা প্রতিপন্ন হয়। নয়া মানবতাবাদের সৃষ্টি মতাদর্শই মনুষ্যত্বের এবং মানবতার বিকাশ ও বিস্তারের মানবেন্দ্রনাথের মনে এই প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত হয় যে, সমকালীন কোন রাজনীতিক। উদারনীতিক, গণতান্ত্রিক প্রভৃতি রাজনীতিক মতাদর্শের চেহারা চরিত্র নিয়ে পরীক্ষা– নিরীক্ষা নিরন্তর । মতানুসারে ফরাসী বিপ্লবোত্তর পৃথিবীতে মার্কসবাদী, ফ্যাসীবাদী, সমাজতান্ত্রিক নতুন রাজনীতিক মতাদর্শের প্রয়োজনীয়তা থেকে কমিউনিস্ট জীবনধারার সমাপ্তিপরিচালিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও ফলাফল সন্তোষজনক প্রতিপন্ন হয়নি। মানুষের অভাব অভিযোগের। পরিতৃপ্তি সাধনের উপায় পদ্ধতি হিসাবে নির্দিষ্ট রাজনীতিক মতাদর্শ অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সফল হয় নি। কোন রাজনীতিক মতাদর্শই মানুষের কষ্ট লাঘব বা প্রয়োজন পূরণ করতে পারে নি। মানবেন্দ্রনাথ সোভিয়েত ধাঁচের সমাজবাদ, উদারনীতিবাদ, ফ্যাসিবাদ প্রভৃতি পর্যালোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে, মানবসমাজের সমস্যা সঙ্কটের সম্যক সমাধানের ব্যাপারে এই সমস্ত প্রচলিত রাজনীতিক । . মতাদর্শগুলির কোনটিই সমর্থ নয়। স্বভাবতই মানবেন্দ্রনাথ নতুন এক রাজনীতিক মতাদর্শ প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন । এই প্রয়োজনীয়তা পূরণের তাগিদেই মানবেন্দ্রনাথ নয়া মানবতাবাদের সৃষ্টি করেছেন। প্রচলিত বিভিন্ন রাজনীতিক মতাদর্শের ত্রুটি – বিচ্যুতি বর্জন করার জন্য বা সীমাবদ্ধতাসমূহ সংশোধন করার জন্য মানবেন্দ্রনাথ নতুন এই রাজনীতিক মতাদর্শ গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। ইউরোপে শিল্পোন্নত দেশগুলিতে শিল্পোন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় নি। এই সমস্ত দেশে পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয়েছে প্রচুর পরিমাণ। কিন্তু বৈষম্যমূলক বণ্টন ব্যবস্থায় বিচ্যুতির কারণে শ্রমিক কৃষকের মত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিল্পোন্নয়নের সুযোগ সুবিধা পায় নি। গ্রেট ব্রিটেনের মত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক দেশেরও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি শিল্পোন্নয়নের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা কুক্ষিগত করেছে । মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে সাম্য ও স্বাধীনতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে সহায়ক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। তা হলে শিল্পোন্নয়নের সুফল দেশের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে সমকালীন কোন রাজনীতিক মতাদর্শই মানবেন্দ্রনাথের কাছে উপযুক্ত প্রতিপন্ন হয় নি। বিদ্যমান রাজনীতিক মতাদর্শসমূহের উপর তিনি আস্থা রাখতে পারেন নি। নতুন মতাদর্শের প্রয়োজনীয়তা প্রতিপন্ন হয়। এবং মানবেন্দ্রনাথ নয়া মানবতাবাদের দর্শন গড়ে তোলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় তাণ্ডব ও অমানুষিক ধ্বংসলীলা মানবজাতি ও মানবসভ্যতার সম্মুখে অভাবনীয় সমস্যা সংকটের সৃষ্টি করে। অপূরণীয় ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি সংকট সৃষ্টি করে। পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ অকারণ প্রতীয়মান হয়। পৃথিবীর শান্তিকামী মানবগোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে পড়ে। মানুষের সকল আশা – ভরসা শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধোত্তর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই মহাশক্তির মধ্যে পারস্পরিক রেষারেষি ও তিক্ততার সম্পর্ক হ্রাস পায় নি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী ঐক্য, সংহতি ও প্রগতির পরিমণ্ডল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে। মানবজাতি ও মানবসভ্যতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এ রকম এক প্রতিকূল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মানবেন্দ্রনাথ বিকল্প সমাজদর্শনের অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছেন। পৃথিবী জুড়ে সভ্যতার সংকট থেকে মানবজাতিকে উদ্ধারের উপায় হিসাবে মানবেন্দ্রনাথ নয়া মানবতাবাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। বৈষম্যমূলক কণ্টন ব্যবস্থার বিচ্যুতি দূরীকরণ যুদ্ধোত্তর বিশ্বে সভ্যতার সংকট নিবারণ মানবতাবাদের বিষয়টি একেবারে অভিনব কিছু নয়।
প্রাচীনকালের গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তাধারার মধ্যে মানবতাবাদের আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। মানবতাবাদী আদর্শের অনুগামী হিসাবে চীনের কনফুসিয়াসের কথাও বলা হয়। ভারতবর্ষের বৈষ্ণব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জীবনদর্শনের মধ্যে মানবতাবাদী চেতনার উজ্জ্বল উপস্থিতি অনস্বীকার্য। আবার এদেশের সন্ত দার্শনিকদের মতাদর্শের মধ্যে মানবতাবাদী মতাদর্শের অস্তিত্ব বর্তমান। বিশ্ববন্দিত দার্শনিক বার্টাণ্ড রাসেল ছিলেন একজন বিশিষ্ট মানবতাবাদী। আবার বৈদান্তিক বিবেকানন্দও ছিলেন একজন বিখ্যাত মানবতাবাদী। মানবতাবাদ নতুন নয় মানবতাবাদ হল এক বিশেষ দার্শনিক ধারণা। এই ধারণার মধ্যে কোন কাল্পনিক শক্তির ঠাঁই নেই। মানবতাবাদ অনুসারে মানুষের মন এবং মেধাই হল যথার্থ উপাদান বা শক্তি। মানব সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে এই শক্তিই হল আসল। মানবতাবাদী ধারণায় সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি এবং মন ও চেতনা শক্তির উপর । কোন রকম অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত শক্তির সমাজদার্শনিকদের অভিমত অনুসারে মানবতাবাদে মানবতাবাদের ধারণা অস্তিত্ব মানবতাবাদে অস্বীকৃত। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যাবতীয় সামাজিক ও রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকাকেই কেন্দ্রীয় গুরুত্ব প্রদান করা হয়। মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে মানবতাবাদ হল মানুষের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের এক প্রাচীন মতবাদ। আধুনিক বিজ্ঞানই এ বিষয়ে আমাদের অবহিত করে। মানবেন্দ্রনাথ রায় হলেন আধুনিক ভারতের প্রথম সারির মানবতাবাদীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মানবেন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দর্শন পূর্বর্তন চলে আসা মানবতাবাদী ধারণা থেকে অনেকাংশে আলাদা। ধারণাগত এই স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করার জন্য মানবেন্দ্রনাথ মানবতাবাদের আগে আমুল সংস্কারবাদ (Radical ) বা নয়া ( New ) শব্দটি সংযুক্ত করেছেন
9) জয় প্রকাশ নারায়ণ মার্কসবাদী প্রহাবকে কিভাবে অতিক্রম করেছিলেন তা আলোচনা করুন ?
Answer – এম এন রায়ের নয়া মানবতাবাদ কি মার্কসবাদকে বর্জন করেছেন মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদ ( New Humanism of Manabendranath) জীবন ও মননের শেষ সমগ্র কর্মজীবন জুড়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রাজনীতিক চিন্তা অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয় নি। কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানবেন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তায় মৌলিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তার জীবন ও মননধারা বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। এবং এ ক্ষেত্রে তিনটি পৃথক পর্যায় পরিলক্ষিত হয়। মানবেন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তায় এটি একটি বড় বৈশিষ্ট্য। কর্মজীবনের গোড়ার দিকে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী। পরবর্তীকালে তিনি মার্কসবাদী দর্শনে দীক্ষিত হন। এবং কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে পর্যায় নয়া মানবতাবাদ মানবেন্দ্রনাথ নয়া মানবতাবাদী দর্শনের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত হন।
মানবেন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারা বিশেষভাবে সমৃদ্ধ । সমগ্র জীবনব্যাপী মানবেন্দ্রনাথ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সমকালীন পৃথিবীতে তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ। মানবেন্দ্রনাথের অনন্য অভিজ্ঞতা ও প্রখর পাণ্ডিত্য পরিণতি লাভ করেছে তাঁর নয়া মানবতাবাদী দর্শনে। মানবেন্দ্রনাথের জীবন ও মননধারার পিছনে একটি পটভূমির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। বিষয়ে মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদী দর্শনে উপনীত হওয়ার কার্যকারণ সম্পর্ক আছে।
মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদী দর্শনে উপনীত হওয়ার পিছনে বিবিধ কার্যকারণ বর্তমান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর কর্মজীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁকে নয়া মানবতাবাদী আদর্শের অনুগামী করেছে। তা ছাড়া সমকালীন বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাও এ ক্ষেত্রে মানবেন্দ্রনাথের মননকে প্রভাবিত করেছে। বিভিন্ন দিক থেকে বিষয়টির বিচার বিশ্লেষণ বাঞ্ছনীয়। মানবেন্দ্রনাথ মানবসভ্যতার সমকালীন নয়া মানবতাবাদ সৃষ্টির সংকটের সমাধানস্বরূপ নয়া মানবতাবাদী দর্শনকে হাজির করেছেন। মানবতার সংকট মানবেন্দ্রনাথকে শংকিত করেছে। মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের অতিপ্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ মানবেন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন। রাজনীতিক দলীয় ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ও অমানবিক পরিণতি মানবেন্দ্রনাথকে বিচলিত করেছে। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে মানবেন্দ্রনাথ জীবন সায়াহ্যে নতুন এক দার্শনিক পথের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করেন। এইভাবে। দার্শনিকের পর্যায়ে উন্নীত হন। মানবেন্দ্রনাথের রাজনীতিক জীবনের বেশ একটি বড় অংশ সমাজতান্ত্রিক ও একসময় মার্কসবাদে মানবেন্দ্রনাথের দীক্ষা হয়। তিনি লেনিনসহ সমকালীন বিশ্বের বিশিষ্ট মার্কসবাদী। সাম্যবাদী মতাদর্শের বিকাশে ও বিস্তারে বায়িত হয়। কিন্তু মানবেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বাধীনতার পুজারী। চিন্তার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই স্বাধীন চিন্তার অনিয়ন্ত্রিত অভিব্যক্তির উপর তিনি বিশেষ জোর দিয়েছেন। । কিন্তু বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন যে, সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা কার্যত অঙ্গীকৃত। গোষ্ঠীও সমাজবাদী সমাজে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। সকলের স্বাধীনতা ভোগ সুনিশ্চিত হবে। এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদ তিনি বুদ্ধিজীবী অনুভব করেন। বস্তুত কমিটার্নের সদস্য থাকাকালীন সময়ের শেষের দিকে মানবেন্দ্রনাথের মনে নতুন এক জীবনদর্শনের বীজ উদ্দীপিত হয়। এই বীজ ক্রমশ অঙ্কুরিত পরবিত হয়। মানবেন্দ্রনাথের মার্কসবাদী জীবনধারার সমাপ্তি ঘটে। কর্মজীবনের এই শেষ পর্যায়ে তিনি ব্যক্তিস্বাতাবাদী নতুন আদর্শকে অবলম্বন করেন। এই নতুন আদর্শই নয়া মানবতাবাদী দর্শন হিসাবে পরিচিত হয়। পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে, মানবেন্দ্রনাথ বহু দিন কাটিয়েছেন। গন প্রজাতন্ত্রী চীনেও তিনি অনেকদিন অতিবাহিত করেছেন। মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার চেহারা চরিত্র একেবারে কাছ থেকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন । পরবর্তীকালে মানবেন্দ্রনাথ মার্কসবাদ ও সোভিয়েত সমাজবাদী সমাজব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহ সবিস্তারে পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কথা ঠিক । কিন্তু সেখানে সবকিছু কমিউনিস্ট পার্টির মুষ্টিমেয় কিছু নেতারা নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক পথে সমাজবাদের আগমনকে সেখানে উৎসাহিত করা হয়নি। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতা বিপন্ন। মার্কসীয় দর্শনের সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদী দর্শনের পার্থক্য প্রসঙ্গে অন্যান্য বিষয়ের উল্লেখ আবশ্যক। সমাজবাদের সীমাবদ্ধত মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে সমাজের প্রয়োজনের তাগিদে ও স্বাভাবিক নিয়মে শিক্ষা সংস্কৃতি, নীতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত ধ্যান–ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। কিন্তু মার্কসীয় দর্শন অনুসারে এই সমস্ত ধ্যান ধারণা হল সংশ্লিষ্ট সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থারই অভিব্যক্তি। আবার মার্কসীয় দর্শনের আর্থনীতিক নির্দেশবানকে মানবেন্দ্রনাথ সত্য বলে স্বীকার করেন নি। মানবেন্দ্রনাথের অভিমত অনুযায়ী মানুষই সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। মানুষের মনন এবং ইচ্ছাশক্তির সৃষ্টি হয় সংশ্লিষ্ট আর্থনীতিক ব্যবস্থার অনুপ্রেরণা থেকে। মানবেন্দ্রনাথ সমগ্র জগতের পারিপার্শ্বিক অবস্থার অংশ হিসাবে মানুষের মনকে বিচার – বিবেচনা করেছেন। মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে এটাই হল বস্তুবাদের মূল বিষয়। তাঁর অভিমত অনুযায়ী কমিউনিস্ট শাসিত সমকালীন রাষ্ট্রসমূহে ব্যক্তি – মানুষ মুক্তির স্বাদ পায় নি। সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপর কর্তৃত্ব কায়েম, ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান এবং উৎপাদন উপাদানসমূহে সামাজিক মালিকানা কায়েম করলে মুক্ত সমাজের সৃষ্টি সুনিশ্চিত হয় না। এ বিষয়েও মার্কসবাদের সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের নয়া মানবতাবাদের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পুঁজিবাদের সীমাবদ্ধতা আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি প্রভৃতি দেশে অবস্থানকালীন সময়ে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং পার্লামেন্টীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আকৃতি – প্রকৃতির সব কিছু সম্যক ভাবে অনুধাবন করেছেন। মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়ে সাড়ম্বর তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে পুঁজিবাদী সমাজে বাছাই করা কিছু মানুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার অবহেলিত হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজের মৌলিক সমস্যাসমূহের সম্যক সমাধান সম্ভবপর নয়। আবার দ্বৈরী শক্তিসমূহের অভ্যুত্থান এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অমানুষিক অত্যাচার সমকালীন বিশ্বে বিপদ হিসাবে দেখা দেয়। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ রকম পরিস্থিতিতে সমাজজীবন থেকে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে অপসারিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বিকল্প ব্যবস্থা। হিসাবে গণতান্ত্রিক পথে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা প্রতিপন্ন হয়। নয়া মানবতাবাদের সৃষ্টি মতাদর্শই মনুষ্যত্বের এবং মানবতার বিকাশ ও বিস্তারের মানবেন্দ্রনাথের মনে এই প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যে, সমকালীন কোন রাজনীতিক।
উদারনীতিক, গণতান্ত্রিক প্রভৃতি রাজনীতিক মতাদর্শের চেহারা – চরিত্র নিয়ে পরীক্ষা– নিরীক্ষা নিরন্তর। মতানুসারে ফরাসী বিপ্লবোত্তর পৃথিবীতে মার্কসবাদী ফ্যাসীবাদী সমাজতান্ত্রিক নতুন রাজনীতিক মতাদর্শের প্রয়োজনীয়তা থেকে কমিউনিস্ট জীবনধারার সমাপ্তিপরিচালিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও ফলাফল সন্তোষজনক। প্রতিপন্ন হয়নি। মানুষের অভাব অভিযোগের। পরিতৃপ্তি সাধনের উপায় পদ্ধতি হিসাবে নির্দিষ্ট রাজনীতিক মতাদর্শ অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু এই উদ্দেশ্য। সফল হয় নি। কোন রাজনীতিক মতাদর্শই মানুষের কষ্ট লাঘব বা প্রয়োজন পূরণ করতে পারে নি। মানবেন্দ্রনাথ সোভিয়েত ধাঁচের সমাজবাদ, উদারনীতিবাদ, ফ্যাসিবাদ প্রভৃতি পর্যালোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে, মানবসমাজের সমস্যা সঙ্কটের সম্যক সমাধানের ব্যাপারে এই সমস্ত প্রচলিত রাজনীতিক । মতাদর্শগুলির কোনটিই সমর্থ নয়। স্বভাবতই মানবেন্দ্রনাথ নতুন এক রাজনীতিক মতাদর্শ প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন । এই প্রয়োজনীয়তা পূরণের তাগিদেই মানবেন্দ্রনাথ নয়া মানবতাবাদের সৃষ্টি করেছেন। প্রচলিত বিভিন্ন রাজনীতিক মতাদর্শের ত্রুটি বিচ্যুতি বর্জন করার জন্য বা সীমাবন্ধতাসমূহ সংশোধন করার জন্য মানবেন্দ্রনাথ নতুন এই রাজনীতিক মতাদর্শ গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। ইউরোপে শিল্পোন্নত দেশগুলিতে শিল্পোন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় নি। এই সমস্ত দেশে পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয়েছে প্রচুর পরিমাণ। কিন্তু বৈষম্যমূলক কটন ব্যবস্থায় বিচ্যুতির কারণে শ্রমিক – কৃষকের মত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিল্পোন্নয়নের সুযোগ সুবিধা পায় নি। গ্রেট ব্রিটেনের মত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক দেশেরও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি শিল্পোন্নয়নের যাবতীয় সুযোগ– সুবিধা কুক্ষিগত করেছে। মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে সাম্য ও স্বাধীনতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে সহায়ক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। তা হলে শিল্পোন্নয়নের সুফল দেশের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে সমকালীন কোন রাজনীতিক মতাদর্শই মানবেন্দ্রনাথের কাছে উপযুক্ত প্রতিপন্ন হয় নি। বিদ্যমান রাজনীতিক মতাদর্শসমূহের উপর তিনি আস্থা রাখতে পারেন নি। নতুন মতাদর্শের প্রয়োজনীয়তা প্রতিপন্ন হয়। এবং মানবেন্দ্রনাথ নয়া মানবতাবাদের দর্শন গড়ে তোলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় তাণ্ডব ও অমানুষিক ধ্বংসলীলা মানবজাতি ও মানবসভ্যতার সম্মুখে অভাবনীয় সমস্যা সংকটের সৃষ্টি করে। অপূরণীয় ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি সংকট সৃষ্টি করে। পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ অকারণ প্রতীয়মান হয়। পৃথিবীর শান্তিকামী মানবগোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে পড়ে। মানুষের সকল আশা – ভরসা শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধোত্তর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই মহাশক্তির মধ্যে পারস্পরিক রেষারেষি ও তিক্ততার সম্পর্ক হ্রাস পায় নি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী ঐক্য, সংহতি ও প্রগতির পরিমণ্ডল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে। মানবজাতি ও মানবসভ্যতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এ রকম এক প্রতিকূল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মানবেন্দ্রনাথ বিকল্প সমাজদর্শনের অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছেন। পৃথিবী জুড়ে সভ্যতার সংকট থেকে মানবজাতিকে উদ্ধারের উপায় হিসাবে মানবেন্দ্রনাথ নয়া মানবতাবাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। বৈষম্যমূলক বণ্টন ব্যবস্থার বিচ্যুতি দূরীকরণ যুদ্ধোত্তর বিশ্বে সভ্যতার সংকট নির্ধারণ মানবতাবাদের বিষয়টি একেবারে অভিনব কিছু নয়।
প্রাচীনকালের গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তাধারার মধ্যে মানবতাবাদের আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। মানবতাবাদী আদর্শের অনুগামী হিসাবে চীনের কনফুসিয়াসের কথাও বলা হয়। ভারতবর্ষের বৈষ্ণব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জীবনদর্শনের মধ্যে মানবতাবাদী চেতনার উজ্জ্বল উপস্থিতি অনস্বীকার্য। আবার এদেশের সম্ভ দার্শনিকদের মতাদর্শের মধ্যে মানবতাবাদী মতাদর্শের অস্তিত্ব বর্তমান। বিশ্ববন্দিত দার্শনিক বাটাও রাসেল ছিলেন একজন বিশিষ্ট মানবতাবাদী। আবার বৈদান্তিক বিবেকানন্দও ছিলেন একজন বিখ্যাত মানবতাবাদী। মানবতাবাদ নতুন নয় মানবতাবাদ হল এক বিশেষ দার্শনিক ধারণা। এই ধারণার মধ্যে কোন কাল্পনিক শক্তির ঠাঁই নেই। মানবতাবাদ অনুসারে মানুষের মন এবং মেধাই হল যথার্থ উপাদান বা শক্তি। মানব সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে এই শক্তিই হল আসল। মানবতাবাদী ধারণায় সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি এবং মন ও চেতনা শক্তির উপর। কোন রকম অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত শক্তির সমাজদার্শনিকদের অভিমত অনুসারে মানবতাবাদে মানবতাবাদের ধারণা অস্তিত্ব মানবতাবাদে অস্বীকৃত। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যাবতীয় সামাজিক ও রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকাকেই কেন্দ্রীয় গুরুত্ব প্রদান করা হয়। মানবেন্দ্রনাথের মতানুসারে মানবতাবাদ হল মানুষের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের এক প্রাচীন মতবাদ। আধুনিক বিজ্ঞানই এ বিষয়ে আমাদের অবহিত করে। মানবেন্দ্রনাথ রায় হলেন আধুনিক ভারতের প্রথম সারির মানবতাবাদীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মানবেন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দর্শন পূর্বতন চলে আসা মানবতাবাদী ধারণা থেকে অনেকাংশে আলাদা। ধারণাগত এই স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করার জন্য মানবেন্দ্রনাথ মানবতাবাদের আগে আমূল সংস্কারবাদ (Radical) বা নয়া ( New ) শব্দটি সংযুক্ত করেছেন।
10) ‘ সর্বোদয় ‘ধারণাটি কার সঙ্গে জড়িত এবং এর অর্থ কি?
Answer – সর্বদা ধারণাটি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এর সঙ্গে জড়িতা সর্বোদয় দর্শন হল মহাত্মার জীবন – বেদে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে গান্ধীজির উপর রাস্কিনের Unto this last গ্রন্থটির প্রভাব সুস্পষ্ট। গান্ধীজি নিজে স্বীকার করে বলেছেন: – That book marked a at turning point in my life. ” তিনি আত্মকথা”য় আরও বলেছেন যে, “ যে সমস্ত গভীর বিশ্বাস আমার হৃদয়ের মধ্যে নিহিত ছিল, এই বইটিতে আমি তাহারই কতকগুলির প্রতিবিম্ব দেখিতে পাইয়াছিলাম। ” গান্ধীজি এই বইটির গুজরাটি সংস্করণের নামকরণ করেন সর্বোদয়। ১৯০৪ সালে সর্বোদয় ধারণার উৎস তাঁর আত্মকথায় গান্ধীজি সর্বোদয়ের তিনটি সিদ্ধান্তের উল্লেখ করেছেন –
(১) সমষ্টির কল্যাণের মধ্যেই ব্যক্তিকল্যাণ নিহিত ।
( ২ ) জীবিকা অর্জনের অধিকার সকলের সমান, তাই উকিল ও নাপিতের কাজের মূল্য অভিন্ন, ।
( ৩ ) শ্রমভিত্তিক জীবনই হল সার্থক জীবন, কারণ শ্রনের গুরুত্বই সর্বাধিক।
রাজনীতিক চিন্তাজগতে মহাত্মা গান্ধী কিছু অবিস্মরণীয় ও অভিনব অবদান রেখেছেন। এ রকম একটি বিষয় হল গান্ধীজির সর্বোদয়তত্ত্ব। মানবসভ্যতার ইতিহাসে গান্ধীজির সর্বোদয় তত্ত্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। মহাত্মা গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে, মানবজাতির জন্য ভবিষ্যতের সুখী সমাজ সর্বোদয় পদ্ধতিতেই গড়ে তোলা যায় । অধ্যাপক জোহারী ( J. C. Johari ) তাঁর Principles of Modern Political science শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন : “ Sarvodaya literally meaning * the uplife of all is the most approprite name of Gandhian socialism. It is a principle of a new philosophical, social, ethical, economic and political order whose aim, in the words of Gandhiji’s spiritual disciple. Vinoba Bhave, is that all may be happy. সর্বোদয়ের অর্থ অর্থ হল সকলের কল্যাণ। সর্বোদয়ের মধ্যে সকলের কল্যাণের ধারণা বিধৃত আছে কোন বিশেষ ব্যক্তি গোষ্ঠী বা শ্রেণীর কল্যাণ নয়। সর্বোদয় সমাজ হল শ্রেণীহীন সমাজ। সকলেই এখানে সমান। জাতি, ধর্ম, সর্বোদয় কথাটি সর্ব এবং উদয় – এই দুটি শব্দের সমাহারে সৃষ্ট। সর্বোদয় কথাটির আক্ষরিক না। সর্বোদয় সকল ধর্মকেই সমান শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সর্বব্যাপী প্রেম প্রীতি ভালোবাসাই হল এ রকম বর্ণ ধনী দরিদ্র, অভিজাত অভাজন – প্রভৃতি কোন কারণে কারও সঙ্গে এখানে কোন রকম পার্থক্য করা হয় সমাজের ভিত্তি। এখানে সরল দুর্বলকে রক্ষা করে প্রত্যেকে প্রত্যেকের মঙ্গল করে এবং সকলেই সমাজের সদস্য হিসাবে গণ্য হয়। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অবদমিত করা বা শোষণ – পীড়নের ঘটনা এখানে ঘটে না। সর্বোদয় সমাজে সকলের কল্যাণ সাধনে সকলে নিযুক্ত থাকবে। ব্যক্তির কল্যাণ সমষ্টির কল্যাণের মধ্যেই নিহিত আছে। সমষ্টিগতভাবে সকল মানুষ ঐক্য ও সংহতি আবদ্ধ থাকবে।
অহিংস বা সুখ – শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার আদর্শমূলক আলোচনা সর্বোদয় তত্ত্বের মধ্যে পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর হিতবাদী দর্শনে সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণের কথা বলা হয়। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সর্বোদয় তত্ত্বে একের পরিবর্তে অপরের কল্যাণ নয়, বলা হয়েছে সকলের কল্যাণের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে সমাজের প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হতে পারে না । উপযোগিতাবাদীদের মত সংখ্যাগরিষ কথা। এই সকলের কল্যাণই হল ভবিষ্যতের যথার্থ সথী সমাজের পূর্বশর্ত। মহাত্মার মতানুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠের মানুষের কল্যাণের উপর জোর দিলে সংখ্যালঘুর স্বার্থ বিপন্ন হবে। অনেকের মতে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সকলের কল্যাণের ভিত্তিতে গান্ধীজির সর্বোদয় ধারণা গড়ে উঠেছে।
আত্মত্যাগ :- সর্বোদয় আত্মত্যাগে বিশ্বাসী। পরার্থে আত্মত্যাগ সর্বোদয়ের মূল আদর্শ। আত্মসুখের পরিবর্তে অপরের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিধানই হবে এখানে প্রত্যেকের আদর্শ, প্রত্যেকের লক্ষ্য হবে অপরের স্বার্থে কিছু দান করা গ্রহণ করা নয়। এ রকম সমাজে কোনরূপ দুদু বা বিদ্বেষ থাকবে না। সর্বোদয় সমস্তে আত্মত্যাগের আদর্শ এবং নেওয়ার পরিবর্তে দেওয়ার মনোভাব মানুষের মধ্যে থাকত হবে। নিজের সুখ – স্বার্থ নয়, অন্য সকলের কল্যাণের জন্য আত্মোৎসর্গের মনোভাব, থাকতে হবে। অধ্যাপক বিশ্বনাথ প্রসাদ ভার্মা (V. P. Varma) এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন : … the significance of Sarvodaya lies in stressing the permanent value of self-abrogation. m. অর্থনৈতিক আদর্শ সর্বোদয় সমাজে উৎপাদনের জন্য প্রত্যেকেই পরিশ্রম করবে। প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুসারে সমাজের জন্য কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুসারে পাওনা পারে। প্রত্যেকে উন্নতির সমান সুযোগ পাবে। এখানে কোন রকম আর্থিক বৈষম্য স্বীকার করা হবে না।
সর্বোদয় কৃষি – শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার পক্ষপাতী কৃষি ও শিল্প হবে পরস্পরের পরিপূরক। গণতান্ত্রিক সমাজবাদ ও মার্কসীয় সমাজবাদে রাষ্ট্র কর্তৃক সম্পত্তি জাতীয়করণের কথা বলা হয়। গণতান্ত্রিক সমাজবাদে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে সম্পত্তি জাতীয়করণের কথা বলা হয়; কিন্তু মার্কসীয় সমাজবাদে ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বলপূর্বক সম্পত্তি জাতীয়করণের কথা বলা হয়। কিন্তু সর্বোদয় তত্ত্বে সম্পত্তির জাতীয়করণের ধারণাকে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় নি। পরিবর্তে গান্ধীজি সম্পত্তির অছিব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অধ্যাপ জোহারী ( J. C. Jorhari) তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। Sarvodaya pleads for villagisation. decentralisation and gifts as those of labou ( Shramndan) of land (Bhoodan) of wealth (sampathidan), and of big shares in village property ( Gramdan ) “নৈতিক পরিবেশ উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়।
সর্বোদয়ের লক্ষ্য হল এক উন্নত নৈতিক পরিবেশ দেশের মধ্যে গড়ে তোলার সর্বোদয় সমাজে এইভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে এবং নৈতিক ও আধ্যাত্বিক গান্ধীজির মতানুসারে সত্য, অহিংসা ও সৎ উপায়ের মাধ্যমে এইরকম নৈতিক পরিলে আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন: “ For me Truth is the sovereign principle, which includes গড়ে তোলা সম্ভব হবে । গান্ধীজি মৌলিক নীতি ও আদর্শ হিসাবে সত্যের উপর গুরু” For me non violence is not a mere philosophical principle. It is the rule and breath of numerous other principles তেমনি অহিংসার নীতিও মহাত্মার কাছে প্রাণশক্তিস্বরূপ। তিনি বলেছেন my life. ” এই সমাজ প্রীতি – ভালোবাসা, সহানুভূতি – সহযোগিতার পূর্ণ হয়ে উঠবে।
11) ‘ আনন্দমঠ ‘ –কে জাতীয়তাবাদী উপন্যাস বলা হয় কেন ?
Answer – আনন্দমঠ উপন্যাস ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তার বা বিকাশ :
জাতীয়তাবোধ : জাতীয়তাবোধ হল একটি গভীর ঐক্যবোধের অনুভূতি। কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় বসবাসকারী জনগনের মধ্যে জাতি, ধর্ম,বর্ণ ভাষা প্রভৃতির কারণে যখন এই ধরণের গভীর ঐক্যবোধের সৃষ্টি হয় এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের সৃষ্টি হয় তখন তাকে জাতীয়তাবোধ বলে। পৃথিবীর যেকোন দেশে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকাশের সঙ্গে সেই দেশের দেশাত্মবোধক ও জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। যে সমস্ত মনীষীরা তাদের লেখার মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং তার লেখা দেশাত্মবোধক উপন্যাস ‘আনন্দমঠ‘।
আনন্দমঠ উপন্যাসের ভূমিকা : আনন্দমঠ উপন্যাসের পটভূমি হল অষ্টাদশ শতকের সন্ন্যাসী–ফকির বিদ্রোহ ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
১) এই উপন্যাসের সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায়ের ত্যাগ, বৈরাগ্য এবং দেশকে স্বাধীন করার জন্য সবকিছু উৎসর্গ করার আদর্শ প্রচার করেন। এই আদর্শের প্রচার পরবর্তীকালে বিপ্লবীদের মধ্যে সংগ্রামী মনোভাবের জন্ম দেয়৷
২) অন্যদিকে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে এই উপন্যাসে। এই বর্ননা এবং পরাধীন মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য সন্তানদের প্রবল প্রচেষ্টা যুব সমাজকে উদ্বেলিত করে তোলে।
৩) দেশকে মাতা রূপে কল্পনা করা হয় এই উপন্যাসে। ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে এই দেশমাতার মুক্তির জন্য সন্তানদলের আবির্ভাব ঘটতে দেখা যায় এখানে। পরবর্তীকালে সন্তানদলের দেশমাতার মুক্তির এই প্রচেষ্টা স্বদেশপ্রেমের জোয়ার সৃষ্টি করে।
৪) বন্দেমাতরম গান ও স্লোগানটি আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসারে বন্দেমাতরম–এর অবদান অপরিসীম। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বন্দেমাতরম গানটি গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন। এই সঙ্গীত ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের প্রাণস্পন্দন হিসাবে কাজ করেছিল। বস্তুতপক্ষে, এই সঙ্গীত ছিল ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামের মূলমন্ত্র।
৫) আনন্দমঠের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের চরমপন্থী ও বিপ্লবীরা দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে তাকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার কাজে ব্রতী হন।
৬) এই উপন্যাসে সত্যানন্দের আহ্বানের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
৭) এই উপন্যাসের অন্যতম নারী চরিত্র কল্যাণী ও শান্তি। এঁদের আদর্শ ও আত্মোৎসর্গের কথা তুলে ধরে দেশের যুবসমাজকে বঙ্কিমচন্দ্র দেশের দেশপ্রেম ও সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন।
মূল্যায়ন : ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ ও তাঁর বন্দেমাতরম গানটির অবদান অপরিসীম। অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনন্দমঠের বঙ্কিমচন্দ্রকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ‘প্রকৃত জনক‘ বলে অভিহিত করেছেন (The real father of Indian Nationalism)|
12) ‘ সামগ্রিক বিপ্লব ‘ বলতে জয়প্রকাশ নারায়ণ কি বলতে চেয়েছিলেন ?
Answer –জয়প্রকাশ নারায়ণ ও সর্বাত্মক বিপ্লব জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর সমগ্র কর্মজীবন জুড়ে অভিন্ন মতাদর্শের অনুগামী ছিলেন না। কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর মতাদর্শগত পরিবর্তন ঘটেছে। Towards Total Revolution Search for an Ideology শীর্ষক গ্রন্থে সর্বাত্মক বিপ্লব সম্পর্কিত জয়প্রকাশ নারায়ণের ধ্যান ধারণার পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় । জয়প্রকাশ নারায়ণ পরিণত বয়সে সর্বাত্মক বিপ্লব সম্পর্কিত এক নতুন মতবাদ গড়ে তুলেন। সর্বাত্মক বিপ্লব বলতে সেই মতবাদকে বোঝায়, যার মাধ্যমে নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শগত লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব। সর্বাত্মক বিপ্লবের মাধ্যমে মানসিক ও বৈষয়িক উভয় ধরনের পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসগত অভিজ্ঞতা থেকে জয়প্রকাশ নারায়ণের মনে এই প্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল যে, ব্যক্তি ও ব্যবস্থা উভয়েরই পরিবর্তন প্রয়োজন এবং শুধু ব্যবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তির পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও ব্যবস্থা উভয়েরই পরিবর্তন সাধন করা আবশ্যক ( সর্বাত্মক বিপ্লব হল এমন এক বিপ্লব যা সকলের জীবনের সর্বস্তরে প্রবিষ্ট হতে পারে। প্রত্যেক মানুষের সমগ্র জীবন সর্বাত্মক বিপ্লবের দ্বারা আলোড়িত হওয়া সম্ভব। জয়প্রকাশ নারায়ণের সর্বাত্মক বিপ্লব শুধু রাজনীতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষের মূল্যবোধ, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি সব কিছুরই সামগ্রিক ও দ্রুত পরিবর্তনই হল সর্বাত্মক বিপ্লব।
এ হল মানবসমাজ ও সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের আমূল পরিবর্তন। সামাজিক– সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক – রাজনীতিক, নৈতিক আধ্যাত্মিক শিক্ষা মতাদর্শ প্রভৃতি ক্ষেত্রসমূহে মৌলিক পরিবর্তন সাধনের উদ্যোগই হল সর্বাত্মক বিপ্লব। এই বিপ্লব হবে অহিংস। এবং এই বিপ্লবের উদ্দেশ্য হবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও যাবতীয় সামাজিক অন্যায় অবিচারের আশু অবসান । সর্বাত্মক বিপ্লব মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের পক্ষে, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে এবং মানুষের অপমানের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। সর্বাত্মক বিপ্লবের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই সামগ্রিক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং এক নতুনতর সমাজ গঠনের পথ প্রশস্ত হয়। সর্বাত্মক বিপ্লবের মাধ্যমে যে পরিবর্তন ঘটে তা হল গুণগত পরিবর্তন এবং সুদূরপ্রসারী। তা ছাড়া এই পরিবর্তন হল বিদ্যুৎগতিযুক্ত এবং মূলাভিমুখী। আদিবাসী – অভাজন, হিন্দু মুসলমান শ্রমিক – কৃষক প্রভৃতি সমাজের সকলের সামগ্রিক উন্নয়নের উদ্যোগ সর্বাত্মক বিপ্লবের মধ্যে বর্তমান। এই বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষ লোভ – হিংসা, শোষণ পীড়ন, অন্যায় অসাম্য সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ প্রভৃতির অমানবিক প্রভাব – প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি পাবে। সর্বাত্মক জনসাধারণের সক্রিয় উদ্যোগের ভিত্তিতে রাজনীতিক ক্ষেত্রে নীতিগত পুনর্জাগরণ সম্পাদিত হয়। সর্বাত্মক বিপ্লব হল ন্যায় ও সত্যের জন্য এক সংগ্রাম। সর্বাত্মক বিপ্লব কোন একক বিপ্লব নয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ সামাজিক, অর্থনীতিক, রাজনীতিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই সমাজ ও সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সামগ্রিক পরিবর্তনের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি মানবসমাজ ও জনজীবনের আকৃতি – প্রকৃতির মৌলিক ও আমূল পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। এ জাতীয় পরিবর্তন একটি মাত্র বিপ্লবের দ্বারা সম্পাদিতহওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রয়োজন হল ধারাবাহিকভাবে বিপ্লব বা বহমান বিপ্লব। সর্বাত্মক বিপ্লব বিরতিবিহীনভাবে অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ সর্বাত্মক বিপ্লব হল এক নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। তবে এই প্রক্রিয় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হতে পারে। মানুষ ও তার সমাজের জীবনধারার পরিস্থিতি ও অবস্থান অনুযায়ী সর্বাত্মক বিপ্লবের প্রক্রিয়া পদ্ধতির পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু বিপ্লব অব্যাহত থাকবে। জয়প্রকাশ নারায়ণের অভিমত অনুসারে সাত ধরনের বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বাত্মক বিপ্লব সম্পাদিত হতে পারে। এই সাত ধরনের বিপ্লব হল: (১) সামাজিক বিপ্লব, ( 2 ) অর্থনীতিক বিপ্লব, ( ৩ ) রাজনীতিক বিপ্লব, ( ৪ ) সাংস্কৃতিক বিপ্লব ( ৫ ) নৈতিক আধ্যাত্মিক বিপ্লব ( ৬ ) শিক্ষাগত বিপ্লব এবং (৭) বৌদ্ধিক বিপ্লব। সর্বাত্মক বিপ্লবের সাফল্যের স্বার্থে এই সাত ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হওয়া সাত রকমের বিপ্লব আবশ্যক। এই সাত প্রকারের বিপ্লব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।
( ১ ) সামাজিক বিপ্লব সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পুনর্গঠনের উপর জোর দেওয়ার কথা বলল হয়। সামাজিক বিপ্লব হল সম – সমাজ গঠনের এক সামগ্রিক হবে। তার পরিবর্তে সর্বোদয়ের আদর্শের ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ সহিষ্ণুতা, অহিংসা প্রভৃতি হল সর্বোদয়ের উদ্যোগ। বিদ্যমান অসম সমাজকে বিদায় দিতে সৃষ্টি করতে হবে। সামা, সততা, বিভিন্ন নীতি। আবার সর্বোদয়ের পদ্ধতি সমাজ পুনগঠন হিসাবে ভুদান, গ্রামদান, চাষ – আবাদ প্রভৃতির কথা বলা হয়। গ্রাম ও শহরের মধ্যে ভারসাম্যহীনতাকে দূর করতে হবে। শহরাঞ্চলের আকার আয়তন এবং অবস্থানের পরিবর্তন সাধন করতে হবে। সমসমাজের স্বার্থে জাতিবাদ ও অস্পৃশ্যতার অবসান ঘটাতে হবে এবং দলিত – শোষিতদের জাগরণকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
2 ) । আর্থনীতিক বিপ্লব : আর্থনীতিক বিপ্লবের মাধ্যমে আর্থনীতিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন সাধনের কথা বলা হয়েছে। আর্থনীতিক বিপ্লবের অন্যতম বিষয় হল সম্পদের মালিকানা ও পরিচালনার ব্যাপারে মৌলিক পরিবর্তন। তিনি সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিরোধিতা করেছেন। কারণ ব্যক্তি মালিকানার মাধ্যমে পুঁজিবাদের এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানার মাধ্যমে সমাজবাদের অশুভ আবির্ভাব ঘটে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিক ব্যবস্থায় মজুরী – দাসত্বের হীনতার মধ্যে মানুষ বাঁধা পড়ে যায়। মানুষের স্বকীয়তা, বুদ্ধি বৃত্তি ও ব্যক্তিত্বের অপমৃত্যু ঘটে। তেমনি আবার রাষ্ট্রীয় সমাজবাদের হিংসা পীড়ন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক নয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ সম্পদের মালিকানা গ্রামসভা বা পঞ্চায়েতের হাতে নাস্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। এবং গণ কমিটির মাধ্যমে তিনি সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থা পরিচালনার পরিকল্পনার কথা বলেছেন।
( ৩ ) রাজনীতিক বিপ্লব : জয়প্রকাশ নারায়ণের অভিমত অনুসারে সর্বাত্মক বিপ্লবের স্বার্থে রাজনীতিক বিপ্লবও অপরিহার্য। রাজনীতিক বিপ্লবের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা দরকার। জয়প্রকাশ নারায়ণের মতানুসারে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রই হল আসল গণতন্ত্র। রাজনীতিক বিপ্লব অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের সৃষ্টি ও সংরক্ষণকে সুনিশ্চিত করবে। সরকারী প্রশাসন ও কাজকর্মের সঙ্গে। গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীও সংযুক্ত হবে। এবং এইভাবে জনসাধারণের শাসন কায়েম হবে। রাষ্ট্রহীন সমাজ সম্ভব নয়। কিন্তু জয়প্রকাশ নারায়ণ দলহীন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। মানব সমাজে রাষ্ট্র থাকবে। কিন্তু রাষ্ট্রকে সর্বশক্তিমান বা সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী হতে দেওয়া চলবে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও কাজকর্মকে সম্যকভাবে সীমাবদ্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রের পাশবিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে খর্ব করার জন্য জনসাধারণের অহিংস ক্ষমতাকে সংগঠিত করতে হবে। মূল্যবোধের পরিবর্তন।
( ৪ ) সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঃ সর্বাত্মক বিপ্লবের জন্য যেমন আর্থনীতিক ও রাজনীতিক বিপ্লব প্রয়োজন, তেমন আর্থ– রাজনীতিক বিপ্লবের জন্য সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন সাধনের স্বার্থে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য ব্যক্তিবর্গ ব্রহ্মচর্য এবং সত্য ও অহিংসার নীতি অনুসরণ করবে। তা ছাড়া সকলে স্বীয় স্বার্থের পরিবর্তে অপরের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য জয়প্রকাশ নারায়ণ কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের উপর জোর দিয়েছেন। ২৮ বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক প্রকৃতির পরিবর্তনা।
( ৫ ) নৈতিক – আধ্যাত্মিক বিপ্লব মানুষ মাত্রেরই শারীরিক প্রয়োজন আছে। শারীরিক প্রয়োজন ছাড়াও মানুষের নৈতিক – আধ্যাত্মিক প্রয়োজনও আছে। মানুষের শারীরিক প্রয়োজনসমূহ মৌলিক । মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করতে হয়। শারীরিক প্রয়োজন পূরণের উপকরণসমূহ স্কুল ও পার্থিব প্রকৃতির। মানুষের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনও পূরণ করা দরকার। মানুষের আধ্যাত্মিক উপলব্ধি এং চেতনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এই কারণে সর্বাত্মক বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক উভয় ধরনের আচার আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার মৌলিক ও আমূল পরিবর্তন সাধনের কথা বলা হয়। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য খাদ্য, পরিধেয় ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অনৈতিক পথে অর্থ উপার্জন, লোভ– লিপ্সা এবং বিলুপ্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ এ ধরনের হীনতা – নীচতা , নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। সর্বাত্মক বিপ্লবকে সার্থক ও সফল করার স্বার্থে ব্যক্তিবর্গের নৈতিক আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন প্রয়োজন।
৬) ভৌতিক বিপ্লব: এর অর্থ রাজনৈতিক বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ভৌতিক বিপ্লব সম্পাদিত হলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা – চেতনার ক্ষেত্রে অভিপ্রেত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। জয়প্রকাশ নারায়ণের অভিমত অনুসারে আ ! সামা ক ও রাজনীতিক পরিবর্তনকে সার্থক করার জন্য জনসাধারণকে সচেতন করা আবশ্যক। অর্থাৎ মানুষের বৌদ্ধিক বিপ্লব দরকার। বৌদ্ধিক বিপ্লবের স্বার্থে তাহিংসার আদর্শ এবং উপাদানসমূহের বিনাশ বাঞ্ছনীয় এবং সমাজ ভাবনায় ও মানসিকতায় পরিবর্তন প্রয়োজন। অধ্যাপক ড. যাবতীয় মহানগুণের সম্যক বিকাশ বাঞ্ছনীয়।
( ৭ ) শিক্ষাগত বিপ্লব : জয়প্রকাশ নারায়ণ সর্বাত্মক বিপ্লবের সাফল্যের স্বার্থে শিক্ষাক্ষেত্রেও বিপ্লবের জীবনের উপযোগী প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও জীবনমুখী শিক্ষার কথা বলেছেন। দেশ ও দেশবাসীর সমস্যাদির সঙ্গে সমগ্র শিক্ষা কাঠামো সংযুক্ত ও করতে হবে। এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে করতে হবে সর্বজনীন। গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য নিরসনের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। মানুষের বুদ্ধির বিকাশ সাধনের ব্যবস্থা করতে হবে।
13) ভারতের দলিত আন্দোলনে জ্যোতিবা ফুলের ভূমিকা সংক্ষেপে আলোচনা করুন?
Answer – ভূমিকা: উনিশ শতকে মহরাষ্ট্রের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে জ্যোতিবা গোবিন্দ ফুলে (১৮২৭–১৮৯০ খ্রি.) এক শ্রদ্ধেয় নাম। শূদ্র– সহ নিম্নশ্রেণির মানুষের সর্বিক উন্নয়নে জ্যোতিবা ফুলে ছিলেন বদ্ধপরিকর। জ্যোতিবার জীবনীকার অধ্যাপক পাওয়ারের মতে “ভারতে সমাজ ও শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত বিপ্লবী” (He was a true revolutionist of India in social reforms and education)।
জ্যোতিবা ফুলের অবদান
[1] যুক্তিবাদী সংস্কার: প্রথম জীবনে জ্যোতিবা ফুলে খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত ও হিন্দুধর্ম–বিরোধী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যুক্তিবাদ ও সাম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাবলির সমাধান ও ধর্মীয়–সামাজিক কুসংস্কারগুলির অবসান ঘটুক। তিনি আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন।
[2] সমাজসংস্কার: মহারাষ্ট্রের জনজীবনে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া আধিপত্য, জাতিভেদ প্রথা এবং শূদ্র ও নারীদের সীমাহীন দুর্দশার বিরুদ্ধে জ্যোতিবা গোবিন্দরাও সস্ত্রীক জেহাদ ঘোষণা করেন। শিশুহত্যা নিবারণের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন ‘হোম ফর প্রিভেনশন অব ইনফ্যানটিসাইড‘। যেখানে সমাজের তথাকথিত অবৈধ ছেলেমেয়েরা (পিতৃমাতৃ পরিচয়হীন) আশ্রয় পেত। দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জ্যোতিবা ফুলে সত্যশোধক সমাজ (১৮৭৩ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
[3] ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতা: জ্যোতিবা ফুলে মনে করতেন—সমাজে দরিদ্র, অস্পৃশ্য ও নীচু জাতের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ব্রাহ্মণগণ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা ‘গুলামগিরি‘ গ্রন্থে তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানান। পাশাপাশি কুনরি, মালি, মাভ, মাহার প্রভৃতি নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য–বিরোধী প্রচার শুরুর মধ্য দিয়ে অব্রাত্মণ আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
[4] নারীকল্যাণ: তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সরব হন এবং শিশুকন্যা হত্যা নিবারণের প্রচেষ্টা চালান। নিম্নবর্ণের নারীদের জন্য মহাত্মা ফুলে যেমন একাধিক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, তেমনই বিদ্যাসাগরের মতো বিধবাবিবাহের সমর্থনে মহারাষ্ট্রে প্রবল আন্দোলনও গড়ে তোলেন।
5] শিক্ষাসংস্কার: জ্যোতিবা মনে করতেন শূদ্রসহ বিভিন্ন নিম্নবর্ণের মানুষকে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসা প্রয়োজন। তাই তিনি ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীবাঈ পুনাতে পশ্চিম ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৫১ খ্রি.)। শিক্ষা সংস্কারক জ্যোতিবার শিক্ষামূলক কাজগুলিতে সাহায্য করেন সদাশিব, বল্লাল পরাঞ্জপে প্রমুখ মারাঠা সংস্কারকগণ।
মূল্যায়ন: যুক্তিবাদ ও আধুনিক মনের অধিকারী জ্যোতিবা ফুলে মহারাষ্ট্রীয় নিম্নবর্ণের মানুষদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আজীবন কাজ করে গেছেন। এমনকি ব্রাহ়মণ্যতন্ত্রের কাঠামো থেকে নিম্নবর্ণের মানুষদের রক্ষার জন্য তিনি ব্রিটিশ শাসনের সাহায্য নিতেও দ্বিধা করেননি। এম আর লেভারলের মতে—”সাম্য ও যুক্তিবাদীতার ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ কাঠামো তৈরির লক্ষ্যে ফুলে কাজ করে গেছেন” (Phule worked for a new social structure built on quality and nationality)।
14) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতে সংঘটিত বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করো।
সূচনা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ভারতে শিল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন সামাজিক শ্রেণি হিসেবে ভারতে শিল্প শ্রমিকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রতিষ্ঠিত ৫৬টি সুতাকলগুলিতে প্রায় ৪৫ হাজার এবং ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ২০টি পাটকলগুলিতে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করত। ভারতের শিল্প–শ্রমিকরা প্রথম থেকে পুঁজিপতি মালিক ও ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন ধরনের শোষণের শিকার হয়। ক্ষুব্ধ এই শ্রমিকরা পরবর্তীকালে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
শ্রমিক আন্দোলনের কারণ
[1] ভারতের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ শ্রমিক আন্দোলনে মদত জোগায়।
[i] ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে ঐক্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ভারতের শ্রমিক শ্রেণি জাতিগত বিভেদ ভুলে গিয়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হয়।
[ii] বালগঙ্গাধর তিলক ও অ্যানি বেসান্তের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা হোমরুল আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে।
[iii] জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের (১৯১৯ খ্রি.) ঘটনা শ্রমিক শ্রেণিকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ করে।
[2] রুশ বিপ্লবের প্রভাব: রাশিয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট নেতা ভি. আই. লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হয়। এই সাফল্য ভারতীয় শ্রমিকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে।
[3] প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ভারতে কারখানার সংখ্যা এবং সেই সঙ্গে শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে শিল্পক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়। ফলে ভারতের শিল্পকারখানাগুলি থেকে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয় এবং প্রচুর শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। বাণিজ্যেও মন্দা দেখা দেয়। এরূপ নানা কারণে ভারতের শ্রমিকদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
[4] অর্থনৈতিক দুরবস্থা: শ্রমিকদের মজুরি ছিল খুবই কম। আর্থিক অনটনের ফলে তাদের জীবন–জীবিকা চালানো মুশকিল হত। এই সঙ্গে তাদের ওপর বিপুল পরিমাণ করের বোঝা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি ঘটনা শ্রমিকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
[5] শোষণ: ভারতের শিল্পকারখানাগুলিতে শ্রমিকদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। দরিদ্র শ্রমিক পরিবারগুলি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের ফলে তাদের রোগভোগ লেগেই থাকত। এরূপ সীমাহীন শোষণের ফলে শ্রমিকরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল।
[6] শ্রমিক সংগঠনগুলির ভূমিকা: ১৯১৮–১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। বি. পি. ওয়াদিয়ার নেতৃত্বে এবং সিঙ্গারাভেল্লু চেট্টিয়ার, রামনাজ্জলু নাইড়, ভি. কল্যাণসুন্দরম্ মুদালিয়ার–এর সহযোগিতায় প্রথম শ্রমিক সংগঠন মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন (১৯১৮ খ্রি.) গড়ে ওঠে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম বৃহত্তর শ্রমিক সংগঠন অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে অন্তত ১২৫টি শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে। শ্রমিক সংগঠনগুলির ছত্রছায়ায় শ্রমিকরা তাদের আন্দোলনের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
[7] কমিউনিস্টদের সহযোগিতা: শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা জীবনযাত্রার মানোয়ন্নন ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারে ভারতে কমিউনিস্ট দলগুলি যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনে হেমন্ত সরকার, পি. সি. যোশি, মিরাজকর, মুজাফফর আহমেদ, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেল্লু চেটিয়ার প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতা বিশেষভাবে সহায়তা করে। শ্রমিক শ্রেণিকে কমিউনিস্টরা সাম্যবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত করে শ্রমিক আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে।
উপসংহার: বোম্বাই, বাংলা, বিহার, মাদ্রাজ, আসাম প্রভৃতি প্রদেশে শ্রমিক আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে।
************************************************************************************************************
EVERGREEN TUTORIAL STUDY CENTER
WhatsApp – 8768868438
নেতাজী সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটি আর্টস ( Arts ) এর সকল সাবজেক্টের নোটস সাজেশন এবং অ্যাসাইনমেন্টের জন্য আপনারা আমাদের সেন্টারে যোগাযোগ করতে পারেন | আমাদের সেন্টারের WhatsApp নাম্বার হল – 8768868438 আমাদের সেন্টার থেকে নোটস নিলে অ্যাসাইনমেন্ট বিনামূল্যে দেয়া হবে | আমাদের সেন্টারে উন্নত মানের কমনযোগ্য নোটস এবং সাজেশন পাওয়া যায় |
*********************************************************************************************************
EVERGREEN TUTORIAL STUDY CENTER
এভারগ্রীন টিউটোরিয়াল স্টাডি সেন্টার
WhatsApp – 8768868438
উন্নত মানের নোটস, অ্যাসাইনমেন্ট এবং সাজেশন এর একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান ।
আমাদের সেন্টার থেকে নোটস নিলে আপনারা 70 % থেকে 80 % এর মতো কমন পেয়ে যাবেন ।
অভিজ্ঞ শিক্ষক মন্ডলী তারা আমাদের সেন্টারের সমস্ত নোটস তৈরি করা হয়।
আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে সবসময় থাকার চেষ্টা করি এবং সমস্ত রকম ভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করি ।
আপনারা আমাদের সেন্টার থেকে নোটস কেন নেবেন?
- BEST QUALITY NOTES
- PERFECT SUGGESTIONS
- ONLINE CLASSES
- FULL SUPPORT & GUIDE
- LOW PRICE
- PRINTED NOTES & SUGGESTIONS
- SPEED POST HOME DELIVERY
কমন যোগ্য নোটস সাজেশন নিতে অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন ।
EVERGREEN TUTORIAL STUDY CENTER
YOUR WAY TO SUCCESS
WhatsApp – 8768868438
***************************************************************************
কেন আমাদের নির্বাচন করবেন ?
- PDF Sample Copy দেখে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে ।
- DTP করা নোট থাকবে।
- আমাদের নিজস্ব শিক্ষক,শিক্ষিকাদের দ্বারা বিভিন্ন রেফারেন্স বই ও নোট থেকে নোটস তৈরি করা হয় |
- পরীক্ষার আগে লাস্ট মিনিট সাজেশান পেয়ে যাবেন।
- সারাবছর সকল আপডেট ও সাহায্য পাবেন।
- 70 – 80% কমন যোগ্য সাজেশান।
- অনলাইন ক্লাসের ব্যাবস্থা।
- By Post, Cash On Delivery (COD) Available
- সমস্ত সেন্টারের থেকে কম মূল্যে উৎকৃষ্ট মানের নোটস ও অ্যাসাইনমেন্ট আমাদের সেন্টারেই পাবেন।
****************************************************************************************************************